একজীবনের বৃত্ত: গালওয়ের সার্কেল অব লাইফ গার্ডেন

বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক সজল মিত্র রিচার্ড। ঘুরে দেখছেন দেশটির দর্শনীয় সব স্থান। সেসব নিয়ে বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য লিখেছেন তিনি। আইরিশ নৈসর্গিক রূপকথার ধারাবাহিক পর্বের ষষ্ঠ গল্পে থাকছে আয়ারল্যান্ডের গালওয়ের সার্কেল অব লাইফ গার্ডেনের কথা।

আয়ারল্যান্ডের গালওয়ের সার্কেল অব লাইফ গার্ডেনের সামনে লেখকছবি: লেখকের সৌজন্যে

সৌন্দর্য ও মানবতার দৃষ্টান্ত বললেই সবচেয়ে ভালো বলা হবে। একদিকে সাগরের শান্ত মায়াময়তা, অন্যদিকে মানবতার সবুজ চিহ্ন। আটলান্টিক পারের নীল জলরাশির সৌন্দর্য দেখার সঙ্গে সবুজের মোহনীয়তা উপভোগের এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

আয়ারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের মায়াময় শহর গালওয়ে—শিল্প, সংস্কৃতি ও সংগীতের রাজধানী বলা চলে। কিন্তু এই শহর শুধু রঙিন উৎসব কিংবা প্রাণবন্ত জনজীবনের জন্যই বিখ্যাত নয়; মানবিকতার এক অনন্য স্মারক হিসেবেও গালওয়ে আজ বিশ্বে বিশেষভাবে পরিচিত। শহরের সল্টহিল সমুদ্রতীরবর্তী কুইনসেন্টেনিয়াল পার্কের বুকে শান্ত, নান্দনিক ও গভীর তাৎপর্যে গড়া একটি বাগান রয়েছে, যার নাম ‘সার্কেল অব লাইফ, ন্যাশনাল অর্গান ডোনার কমেমোরেটিভ গার্ডেন’। নামের মতোই এর প্রতিটি ইট, পাথর ও বৃক্ষ বয়ে বেড়ায় জীবনের পুনর্জাগরণের বার্তা।

এক মায়ের অশ্রু থেকে মানবতার স্মৃতিসৌধ
এই বাগানের জন্মকথা যেন এক অনবদ্য মানবগাথা। ২০০৬ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় অ্যামন গগিন নামের এক তরুণ প্রাণ হারান। মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুসারে অঙ্গদান করা হয়, যা কয়েকজন অসুস্থ মানুষের জীবনে নতুন আলো জ্বালায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অ্যামনের মা–বাবা, ডেনিস ও মার্টিনা গগিন, শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে গড়ে তোলেন স্ট্রেঞ্জ বোট ডোনার ফাউন্ডেশন। তাঁদের স্বপ্ন ছিল—যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে মৃত্যুর পরও অন্যের জীবনে আলো জ্বালান, সেই অঙ্গদাতাদের স্মরণে একটি জাতীয় স্মারক নির্মাণ।

গালওয়ে সিটি কাউন্সিলের সহায়তায় এবং অগণিত স্বেচ্ছাদানের টানে শুরু হয় এক মহৎ যাত্রা। প্রায় এক লাখ পঞ্চাশ হাজার ইউরো ব্যয়ে, বহু স্থপতি, শিল্পী ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতায়, ২০১৪ সালের মে মাসে উদ্বোধন হয় এই সার্কেল অব লাইফ গার্ডেন। উদ্বোধনের দিন আয়ারল্যান্ডের নানা প্রান্ত থেকে অঙ্গদাতা পরিবার, চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ সমবেত হয়ে এক হৃদয়স্পর্শী মুহূর্তের সাক্ষী হন।

আরও পড়ুন

আকার ও বিন্যাস: পাথরে লেখা জীবনগাথা
প্রায় এক একর আয়তনের এই বাগান ছোট হলেও, এর প্রতিটি অংশ শিল্পকলা ও প্রতীকতায় পূর্ণ। কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি প্রায় দুই মিটার উঁচু পাথর—স্ট্যান্ডিং স্টোন (দাঁড়ানো পাথর)। এরা জীবনের বিভিন্ন স্তর ও পারস্পরিক সংযোগের প্রতীক। বৃত্তাকারে সাজানো এই পাথরগুলোর কাছেই বাগানের নামের উৎস ‘সার্কেল অব লাইফ’—জীবনের অন্তহীন চক্র।

বাগানটির নকশায় দেখা যায় আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন মঠ-স্মৃতিস্তম্ভ, কেল্লা ও প্রাকৃতিক পাথরের দেয়ালের অনুকৃতি। ফলে একদিকে আধুনিক মানবিকতার বার্তা, অন্যদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের ছোঁয়া—দুটি মিলে এখানে তৈরি হয়েছে স্মরণ ও ধ্যানের এক পরিবেশ।

ঐতিহ্যের প্রতীকী উপাদান
এই বাগান কেবল ফুল, পাথরে সাজানো কিংবা সবুজাভ নয়; এর প্রতিটি উপাদান বহন করে গভীর প্রতীকী অর্থ।
• স্টোন অব ইউনিফিকেশন: বাগানের কেন্দ্রে স্থাপিত প্রধান শিলাখণ্ডটি সংগৃহীত হয়েছে ঐতিহাসিক ক্লনম্যাকনয়েস মঠভূমি থেকে। এটি দাতাদের আত্মত্যাগ ও জীবনের ঐক্যের প্রতীক।
• হেরিটেজ ওয়াল: আয়ারল্যান্ডের ৩২টি কাউন্টি থেকে সংগ্রহ করা পাথর দিয়ে তৈরি একটি দেয়াল। যেন গোটা দেশ অঙ্গদাতাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে একত্র হয়েছে।
• গ্লোবাল হেরিটেজ স্টোনস ট্রেইল: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনা পাথরের এক অনন্য পথ। এখানে রয়েছে তাজমহল, মাচু পিচু, গ্রেট ওয়াল অব চায়না, রবিন আইল্যান্ড কিংবা নিউগ্রেঞ্জের মতো মহামানবীয় স্মারক–সম্পর্কিত শিলা। উদ্দেশ্য একটাই—অঙ্গদান কেবল জাতীয় নয়, এটি মানবতার সর্বজনীন সম্পদ।
• স্টোন-স্কাল্পটেড ক্যান্ডেল: চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নির্মিত মোমবাতি-আকৃতির পাথরের ভাস্কর্য, যা আলো ও জীবনের প্রতীক।

এ ছাড়া রয়েছে নানা বুনোফুলে সাজানো পরিধি, বসার স্থান, শান্ত জলের ধারা ও সেতু। যেখানে বসে দর্শনার্থী সহজেই শোককে ধ্যান ও আশার স্রোতে রূপ দিতে পারেন।

আয়ারল্যান্ডের গালওয়ের সার্কেল অব লাইফ গার্ডেন
ছবি: লেখক

কেন নির্মিত: শোক থেকে আলোয়
সার্কেল অব লাইফ গার্ডেন শুধু একটি স্মৃতিস্তম্ভ নয়; এটি মানবতার এক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে আসলে মানুষ শেখে—মৃত্যুর পরও জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। অঙ্গদানকারীরা তাঁদের অমূল্য অবদানে যাঁদের জীবন রক্ষা করেছেন, এই বাগান তাঁদের উদ্দেশে এক স্থায়ী কৃতজ্ঞতা।

একই সঙ্গে, এটি অঙ্গদান সম্পর্কে জনসচেতনতা জাগায়। আয়ারল্যান্ডে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় প্রাণ হারান। এই বাগান মানুষকে উৎসাহিত করে, তাঁরা যেন অঙ্গদাতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যের জীবনে আলো ছড়াতে পারেন।

বর্তমান রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রদায়ের ভূমিকা
স্ট্রেঞ্জ বোট ডোনার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্মিত এই বাগান আজ গালওয়ে সিটি কাউন্সিল ও গালওয়ে সিভিক স্ট্রাস্টের সহযোগিতায় রক্ষণাবেক্ষিত হয়। মূলত এটি টিকে আছে জনমানুষের ভালোবাসা, স্বেচ্ছাদান ও স্মৃতির আবেগে। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক দর্শনার্থী—সবাই এখানে এসে এক অনন্য প্রশান্তি খুঁজে পান।

আরও পড়ুন

নান্দনিকতা ও অনুভূতি
যখন গালওয়ে উপসাগরের হাওয়া ছুঁয়ে যায় এই বাগানের সবুজ ঘাস, তখন মনে হয় প্রকৃতি নিজেই অঙ্গদাতাদের আত্মাকে আশীর্বাদ করছে। প্রতিটি পাথরের ওপর খোদাই করা বার্তা দর্শনার্থীকে থামিয়ে দেয়—একটু ভাবতে শেখায়, জীবনের মূল্য কতখানি। বাগানের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হয়, এটি কোনো শোকের স্থান নয়, বরং জীবনের জয়গানের মঞ্চ।

এখানে যে নীরবতা বিরাজ করে, সেটি মৃত্যু নয়; বরং জীবনের ধারাবাহিকতা। প্রতিটি ফুল, প্রতিটি পাথর যেন বলছে—‘জীবন শেষ হয় না, এটি শুধু অন্য কারও শ্বাসে বেঁচে থাকে।’

সার্কেল অব লাইফ: মানবতার এক অনন্ত প্রতীক
আধুনিক বিশ্বে যেখানে স্বার্থপরতা ও প্রতিযোগিতা মানুষকে বিভক্ত করে, সেখানে গালওয়ের এই ছোট্ট বাগান শেখায় নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের মহিমা। এটি প্রমাণ করে—মানুষ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে পারে, যদি তাঁর দান অন্য কারও প্রাণে আলো জ্বালায়।

গালওয়ের সার্কেল অব লাইফ গার্ডেন আজ কেবল আয়ারল্যান্ড নয়, গোটা বিশ্বের অঙ্গদাতা পরিবার ও গ্রহীতাদের জন্য আশ্রয়ের প্রতীক। এখানে এসে কেউ নিঃশব্দে অশ্রু ঝরান, কেউ–বা প্রার্থনায় ডুবে যান, আবার কেউ অঙ্গদাতা হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফেরেন।

এই বাগান তাই কেবল একটি উদ্যান নয়, বরং মানবতার এক সোনালি অধ্যায়—যেখানে শোক, স্মৃতি, ঐতিহ্য ও আশার এক মহাসম্মিলন ঘটে। গালওয়ের সমুদ্রতীরবর্তী এই শান্ত বৃত্তটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘জীবন হয়তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু মানবতার আলো চিরন্তন।’

ঘুরলাম, দেখলাম। এমন নিদর্শন চোখের সামনে দেখে অনেকটাই আবেগ আপ্লুত। এবার ফেরার পালা। ফিরতি যাত্রায় আবারও ওয়েস্টমিথ। তবে চোখে লেগে থাকা স্মৃতির ভাস্কর্যের প্রতিমূর্তিগুলো ভাসছে। মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলছি। দিনটা কাটল অসাধারণ।

ওয়েস্টমিথ কাউন্টি, আয়ারল্যান্ড