প্রথম আকাশযাত্রা: এক ফ্লাইটেই বদলে গেল জীবন
জীবনে কিছু অভিজ্ঞতা থাকে, যেগুলো সময়ের সঙ্গে পুরোনো হয় না; বরং যত দিন যায়, ততই স্মৃতির রঙে আরও গভীর হয়ে ওঠে। আমার প্রথম বিমানযাত্রাটাও ঠিক তেমনি একটা দিন, একটা মুহূর্ত, একটা যাত্রা। সেই যাত্রা আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে।
২০১৪ সাল। আমি তখন খুবই তরুণ, অভিজ্ঞতা বলতে গেলে শূন্য। সেদিন ঢাকা থেকে কাতারের দোহা যাওয়ার জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে উঠি। এটা ছিল জীবনের প্রথম ফ্লাইট, আর আমি একা। পাশে অচেনা মানুষ, আর আমার চোখমুখে ভয় ও কৌতূহলের ছাপ। ভয়েও ছিলাম, আবার একধরনের উত্তেজনাও ছিল। মাথার মধ্যে ঘুরছিল একটা প্রশ্ন—‘এত বড় একটা লোহার জিনিস, এত মানুষ নিয়ে কীভাবে আকাশে উড়তে পারে?’ আজও সেই বিস্ময়টা মনে পড়ে।
জানালার পাশে বসে আকাশে ওঠার মুহূর্তটা ছিল অসাধারণ। বিমান যখন রানওয়ে ছেড়ে ওপরে উঠছিল, মনে হচ্ছিল হৃৎস্পন্দন থেমে যাচ্ছে ভয়ে নয়, আনন্দে। আকাশের নীল আর মেঘের সাদা স্রোতে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
বিমানের খাবার খেয়েছিলাম ভাত, গরুর মাংস আর ঠান্ডা কোকাকোলা। সেই স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। তবে, নার্ভাস হয়ে প্রায় ছয়বার পানি চেয়ে নিয়েছিলাম।
আমার হাতে ছিল নকিয়ার একটা বাটন ফোন। ফোনের একটাই ক্যামেরা ছিল। সেটা দিয়ে জানালার বাইরে আকাশের ছবি তুলছিলাম, আর নিজের জীবনের প্রথম সেলফিটাও তুলেছিলাম বিমানের ভেতর। এখন কেউ বিমানে ছবি তুললে অনেকে হাসে বা বিরক্ত হয়। ভাবে, এত কীসের উৎসাহ? কিন্তু আমি জানি, প্রথম ফ্লাইটের অনুভূতি কেমন হয়। আজও কেউ প্রথমবার সেলফি তুললে আমি যেন নিজের শুরুটাতেই ফিরে পাই।
এখন ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এই দীর্ঘ সময়ে প্রায় ১০০ বার আকাশপথে ভ্রমণ করেছি, ৩১টির বেশি এয়ারলাইনসে চড়েছি। বিশ্বের নানা প্রান্তে গিয়েছি, নতুন মানুষ চিনেছি, সংস্কৃতি জেনেছি, ভাষা শিখেছি। তবু সেই প্রথম ফ্লাইটটাই আমার জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে আছে।
সেই ফ্লাইটের যাত্রা যেন আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল বিশাল পৃথিবীর দিগন্ত। দোহায় অবতরণের পর অঙ্গীকার করেছিলাম শুধু সিলেট বা বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকব না, সারা দুনিয়া ঘুরে দেখব।
এরপর শুরু হলো পরিশ্রম। অনেক কষ্ট করেছি, অনেক রাত জেগেছি, কিন্তু থামিনি। কাতারে আসার পর শুরুতে একটি মোবাইল শপে সেলসম্যান হিসেবে কাজ শুরু করি। কয়েক দিন কাজ করার পর বুঝতে পারলাম, এখানে ভালো আয় করতে হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা জরুরি। একটি ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হই। প্রায় ছয় মাস পর লাইসেন্স হাতে পাই। এটাই ছিল জীবনের বড় পরিবর্তনের শুরু।
লাইসেন্স পাওয়ার পর প্রথমে একটি ফোর স্টার হোটেলে ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করি। কিছুদিন পর একটি ফাইভ স্টার হোটেলে এয়ারপোর্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে চাকরি পাই। এই সময়ে বেতন ও টিপস মিলিয়ে ভালো সেভিংস জমাতে শুরু করি।
ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল ব্যবসা করার। মাথায় সব সময় নতুন নতুন আইডিয়া আসত। সময় বা সাহস না থাকায় শুরু করতে পারিনি। ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করে চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে পোশাকের ব্যবসা শুরু করি। শুরুতে ব্যবসা তেমন ভালো চলেনি। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার শুরু করলাম, ধীরে ধীরে উন্নতি হতে থাকে।
প্রায় দুই বছর পর চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ব্যবসায় মনোনিবেশ করলাম। অনলাইনের পাশাপাশি একটি আউটলেট খুলে ফেলি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বড় হতে থাকে এবং স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে যায়।
ব্যবসা ভালো হওয়ার পর ভ্রমণ শুরু করি। ২০১৭ সালে আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ ছিল মালয়েশিয়ায়। তারপর থেকে থেমে নেই। আলহামদুলিল্লাহ, আজ পর্যন্ত ইউএসএ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ ১৮টি দেশে ভ্রমণ করেছি।
ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। এখন পোশাকের পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্সি, ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট এবং হোলসেল ব্যবসাও করছি। সেই সঙ্গে বেড়েছে স্বপ্ন।
প্রথমবার বিমানযাত্রা আমাকে শিখিয়েছিল জীবন ছোট, কিন্তু স্বপ্ন দেখার সাহসটা হতে হবে বড়। যদি সেদিন ভয়ে পিছিয়ে যেতাম, হয়তো আজকের আমি হতাম না। তাই বলি, একটা ফ্লাইট শুধুই ভ্রমণ ছিল না, এটা ছিল আমার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা, এক নতুন আমাকে খুঁজে পাওয়ার গল্প।
উপদেষ্টা, কাতার বন্ধুসভা