বাবার প্রয়াণ একটু হলেও ভুলিয়েছিল যে সময়

বন্ধুসভার লেখক বন্ধু উৎসবে সেরা লেখক পুরস্কার গ্রহণের সময়
ছবি: বন্ধুসভা

দীর্ঘ ৯ বছরের বন্ধুত্ব। পথ চলেছি একসঙ্গে ৯টি বছর। এই ছেড়ে যাওয়া লাভ-লসের হিসাব করার মতো অসুস্থ সময়েও আমি তাকে ছাড়িনি! কোন সম্পর্ক হতে পারে? কী এমন নাম তার? যাকে নিয়ে কথা বলছি! যাকে ছাড়িনি! আন্দাজ করা যাচ্ছে? আচ্ছা আমিই বলে দিচ্ছি—প্রথম আলো বন্ধুসভা। সিরাজগঞ্জ বন্ধুসভায় ২০১৭ সাল থেকে, এখন ২০২৫।

২০২৩ সালে প্রথম আলো বন্ধুসভা প্রথমবারের মতো আয়োজন করে লেখক বন্ধু উৎসব। আমার প্রকাশিত গ্রন্থ এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখলেও প্রথম আলো বন্ধুসভার পাতায় বা ওয়েবসাইটে নিয়মিত লেখা ছাপা না হওয়ায় সুযোগই পাচ্ছিলাম না এমন সুন্দর আয়োজনে অংশ নেবার। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সাবেক সভাপতি মুমিত আল রশিদ স্যারকে বলার পর সুযোগ তৈরি হয়। সেবার সেরা লেখক বন্ধু পুরস্কারের সময় আমার চোখ আটকে গিয়েছিল বাঁধাই করা সুন্দর সনদের দিকে! মনে বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ আমাকে লেখার যে ক্ষমতা ও বোধটুকু দিয়েছেন, এটুকু আগলে রাখলে একদিন ওই সনদ আমার কাছেও আসবে।

এরপর থেকে নিয়মিত বন্ধুসভার ওয়েবসাইট ও পাতায় লিখতে থাকলাম। লেখা পাঠিয়ে চুপচাপ পাতা ও ওয়েবসাইট চেক করতাম। যখন লেখা প্রকাশিত হতো, ভালো লাগত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের টাইমলাইনে শেয়ার দিতাম অন্যদের পড়ার জন্য। এভাবেই চলে এল ২০২৫।

পুরস্কার নেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম, ভাবছিলাম এটা কি আমি সত্যি সত্যিই পেয়েছি!

গত ২৮ মে অংশ নিই বন্ধুসভার ভার্চ্যুয়াল লেখালেখি কর্মশালার প্রথম পর্বে। ফিচার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন। ২৯ মে, ১ জুন ও ৫ জুন— আরও তিনটি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোতে যথাক্রমে কবিতা, গল্প ও সংবাদ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন কবি কামরুজ্জামান কামু, কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল ও প্রথম আলোর হেড অব ডিপ নিউজ রাজীব আহমেদ। চারটি কর্মশালায় সারা দেশের অসংখ্য বন্ধু অংশ নেন।

এরপর ১৯ জুন সন্ধ্যায় হুট করেই বন্ধুসভার ওয়েবসাইটে লেখক বন্ধু উৎসব ২০২৫-এর ঘোষণা দেখে রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধ করে ফেলি। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সম্ভবত রাত আটটা। তখনো ফরমের তথ্যগুলো পূরণ করার জন্য ফোন ঘাঁটছিলাম। ঠিক তখনই মনের মধ্যে কেমন অস্থিরতা শুরু হয়। ফোনটা রেখে অসুস্থ আব্বার ঘরে ছুটে যাই। কালেমা পড়ি বাবার কানের কাছে কিছুক্ষণ। এরপর বাবার ঘর থেকে বের হয়ে দরজায় বসে ছিলাম। একটু পর আব্বার নড়াচড়া দেখে আবার এগিয়ে যাই। আল্লাহ যে আমাদের কঠিন সময়ের সম্মুখীন করতে যাচ্ছে, তখনো বুঝিনি! তবু ভেতর থেকে কেন যেন আমার কালেমা পড়া বের হয়ে যাচ্ছিল। কালেমা পড়তে পড়তেই দেখতে পেলাম আব্বা নির্জীব হয়ে গেলেন আমারই চোখের সামনে। আমার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছিল। বোনকে ডাকলাম, তারপর নেমে এল চিরাচরিত পরকালের অনন্ত জীবনের মতো ঘোর অন্ধকার আর দুঃখ!

আরও পড়ুন

পরিবার আমার ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য মানতে পারছিল না। লেখক বন্ধু উৎসব সম্পর্কে বললাম বাবার মৃত্যুর চার দিন পর। পরিবার বলল, তুমি ওখানে যাও। তুমি তোমার লেখালেখি এবং সব কাজ আগের মতোই রাখো, কিচ্ছু থামিয়ো না। একই কথা বান্ধবী শারমিন ও ভালোবাসার মানুষ নীলও বলেছে। ফরমটা আব্বার মৃত্যুর চার দিন পর পূরণ করি।

একটি সন্তান যখন বাবাহারা হয়, তার পরিস্থিতি হয়তো বলে বোঝানো যাবে না। ১১ জুলাই বিষাদ মন নিয়ে লেখক বন্ধু উৎসবে অংশ নেওয়ার উদ্দেশে পা বাড়াই। রাস্তায় যেতে যেতে ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলের গাছেরা তার ভেজা পাতা ও ফুলের দোল থেকে জানাল জেগে ওঠো জান্নাত। বেঁচে তো থাকতে হবে!

বন্ধুসভার কক্ষে প্রবেশের নাম এন্ট্রি করে কলম, খাতা আর পরিচয়পত্র ইত্যাদি নিয়ে সকালের নাশতা সেরে সারা দেশ থেকে আসা নির্বাচিত বন্ধুদের নিয়ে শুরু হয় লেখক বন্ধু উৎসব। এত বিষাদের মধ্যেও সবাইকে মনে হচ্ছিল বন্ধুসভা একটি বৃন্ত, আর সেখানে ফুটে আছে এতগুলো ফুল! সবাই যার যার মতো ছবি তুলছিল, তখন আমার যে মানসিক অবস্থা ছিল কোনোমতেই ছবি তোলার ইচ্ছা জাগেনি! চুপচাপ বসে ছিলাম। দেখছিলাম, শুনছিলাম। একটু পরেই শুরু হয় পরিচয়পর্ব এবং আগত আলোচকদের মূল্যবান আলোচনা। আলোচক হিসেবে ছিলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, কবি কামরুজ্জামান কামু, কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল ও প্রথম আলোর ‘অন্য আলো’র (সাহিত্য) জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ফিরোজ এহতেশাম।

এত বন্ধু, এত প্রিয় জায়গা বন্ধুসভা, এত সুন্দর আয়োজনেও আমাকে আব্বার শূন্যতা খেয়ে ফেলছিল প্রতিনিয়ত।

আলোচকদের বর্ণিল আলোচনার একেকটি কথা আমার কাছে উড়তে থাকা শিকারি ইগলের চোখের মতো লাগছিল। কখনো মনে হচ্ছিল তাঁরা যা বলছেন, তা মিলে যাচ্ছে আমার সঙ্গে। তাঁদের বলা সব কথাই যেন জন্মের পর থেকে লেখালেখির জন্যই খোদা তাআলা আমার মধ্যেই পাঠিয়েছেন। আবার মনে হচ্ছিল কথারা যেন রঙিন কোমল পালক হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে হল রুমে—প্রতিটি পালকের রং ও নরম যেন স্পর্শ করে যাচ্ছিল আগত প্রতিটি প্রাণ ও লেখকসত্তাকে!

এসব কথার দৃশ্যতেই আমার চোখ নিমেষেই দেখে নিল কারও কারও হৃদয়ের কথা! কারও অভ্যন্তরীণ চোখ বলছিল, তাঁরা এই আয়োজন থেকে ফিরে গিয়ে সর্বোচ্চ কিছু দিয়ে লিখে যাবেন, লেখাকেই ভালোবেসে নেবেন। প্রথমবার আগত বন্ধুদের অনেকেই সবকিছুতেই যেন মুগ্ধতাই খুঁজে পাচ্ছিলেন। তাই তাঁরা কী করবেন না করবেন, তা ভেবে না পেয়ে মুগ্ধতাটুকুই উপলব্ধি করছিলেন।

মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই দ্রুত হেঁটে এল দুপুরের বিরতি। সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে কেউ কেউ ফ্রেশ হতে যাচ্ছিল, কেউ জুমার নামাজে, কেউ আবার ক্যানটিনে খাবার খেতে। আর আমি শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টায়—ব্যর্থতাই খুঁজে পাচ্ছিলাম। সভাকক্ষের পাশেই লাইব্রেরি রুমে খুঁজে নিলাম নামাজের জায়গা। সদ্য প্রয়াত আব্বার জন্য নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। এত বন্ধু, এত প্রিয় জায়গা বন্ধুসভা, এত সুন্দর আয়োজনেও আমাকে আব্বার শূন্যতা খেয়ে ফেলছিল প্রতিনিয়ত। সিজদায়-মোনাজাতে চোখের কাজল ধুয়ে পড়ছিল হৃদয় চুয়ানো জলে! আব্বার পাশাপাশি প্রয়াত সব প্রাণের জন্য প্রার্থনা শেষ করে খাবার খেয়ে ফিরে এলাম সেশনে।

আরও পড়ুন

দুপুরের পর লেখক-প্রকাশক আলাপচারিতা পর্ব। আলোচক হিসেবে ছিলেন সুবর্ণ প্রকাশনীর প্রকাশক শাহরিন হক, নৈঋতা ক্যাফের প্রকাশনা উপদেষ্টা রাহেল রাজিব ও স্বরে-অ প্রকাশনীর প্রকাশক আবু বকর সিদ্দিক। এ পর্বে তরুণ লেখক বন্ধুদের কথা ভেবে মাথায় একটি প্রশ্ন এলে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণের ইচ্ছা জেগে যায়।

ঘড়ির কাঁটার অস্থিরতায় লেখক বন্ধু উৎসব যেন এবারের মতো অন্তিম সুরে গান গেয়ে উঠছিল। শেষবেলায় কেউ কেউ অনুভূতি ব্যক্ত করছিল—কে কী নিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদিতে মাহবুব পারভেজ স্যার সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন আমরা এ মুহূর্ত আর ফিরে পাব না। তাই সবাই যেন সবার সঙ্গে যোগাযোগের মতো একটা শক্ত বন্ধুত্বটুকু নিয়ে যায়।

মাইক্রোফোনে সৌমেন্দ্রদা ঘোষণা দিলেন এবার সেরা পাঁচ লেখক বন্ধু পুরস্কার পর্ব। বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক বললেন, ‘আমরা চাই, বন্ধুসভার লেখক বন্ধু পুরস্কার বাংলাদেশের যেকোনো সামাজিক সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ লেখক পুরস্কার হবে।’ তাঁর এ কথায় সবার মধ্যে উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা—কারা পাচ্ছেন সেরা লেখক পুরস্কার!

ঘোষণার শুরুতেই আমার নাম! সঙ্গে সঙ্গে আমার বিস্ময়ে ভরা হাঁ হওয়া মুখটায় হাত চেপে বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। পুরস্কার নেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম, ভাবছিলাম এটা কি আমি সত্যি সত্যিই পেয়েছি! সবাই আনন্দিত হয়ে বলছিল, ‘নূরে জান্নাত দৌড়াও।’ আমিও যেন ওই মুহূর্তটায় আব্বাকে হারানোর চিরাচরিত বিচ্ছেদের শোক একমুহূর্তের জন্য হলেও ভুলে গিয়ে সেই আগের চঞ্চল, উৎফুল্ল ও আত্মবিশ্বাসী আমার আমি ইচ্ছের সব ডানা মেলে পাখি হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল, লেখক বন্ধু উৎসব যেন পাখিদের অভয়ারণ্য; সেখানে আগত সব বন্ধুই একটি করে পাখি—এই আয়োজন মেলে দিয়েছে তাদের ইচ্ছের ডানা!

বন্ধু, সিরাজগঞ্জ বন্ধুসভা