বন্ধুত্ব, বৃষ্টি আর সাহিত্যের দিনলিপি

লেখক বন্ধু উৎসবে অংশগ্রহণের সনদ গ্রহণের সময়ছবি: বন্ধুসভা
প্রথমবারের মতো কোনো কেন্দ্রীয় আয়োজনে অংশগ্রহণ, দেশসেরা লেখকদের কাছ থেকে শেখা আর সাহচর্য পাওয়া—আমার লেখকজীবনের প্রথম বড় অর্জন।

মুঠোফোনে অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ২টা ৫ মিনিট। দেরি না করে উঠে পড়লাম। প্রস্তুতি নিতে থাকলাম ভোর চারটার ট্রেনে ঢাকা যাওয়ার জন্য।

মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা আর উত্তেজনা কাজ করছিল। যদিও ভয়ও ছিল, সেটা কেটে গেল রাসেল ভাইয়ের ফোনে। তিনি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। ট্রেন মিস করলে লেখক বন্ধু উৎসবে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। আমি নিচে আসছি, সঙ্গে এক বড় ভাইও আছেন। তিনি আমাদেরকে কিছুটা পথ এগিয়ে দেবেন।’

এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। রাসেল ভাই আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন ছাতা নিতে ভুল না করতে। কথামতো ছাতা নিয়ে বের হলাম। ঘড়ির কাঁটা তখনো গভীর রাত পেরিয়ে ভোরের অপেক্ষায়। রাস্তায় নীরবতা, মাঝেমধ্যে কুকুরের ডাক। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে এগিয়ে চলছি স্টেশনের দিকে।

রাতের স্টেশন একেবারে ভিন্ন এক জগৎ। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভিজে থাকা প্ল্যাটফর্ম, দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তি, আর ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা কিছু যাত্রী। এই নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ একটি মালবাহী ট্রেন এল। হেডলাইটের আলোয় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন মুক্তোর মতো ঝলমল করে উঠল। একটু পর একে একে এসে হাজির হলেন নাহিদ ভাই, প্রিয়াংকা আপু, মিশু আপু, আনাস ভাই ও মেধা আপু। ট্রেন এল, আমরা উঠে পড়লাম। জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন সাহিত্যের কোনো গল্পে ঢুকে পড়েছি। কেউ চুপচাপ, কেউবা আনন্দে মুখর—এই মিলনমেলা আসলে শুরু হয়েছে ট্রেনের কামরাতেই।

কমলাপুর পৌঁছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রওনা দিলাম কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়ের দিকে। চারপাশে তখনো বৃষ্টির ধারা, তার মধ্যেই চোখে পড়ল রাস্তার পাশে এক জীবন্ত কাঁচাবাজার। আধুনিক ঢাকায় এমন রঙিন, প্রাণবন্ত শাকসবজির ভোরবাজার সত্যিই প্রথম দেখলাম। বৃষ্টিভেজা সবজি, হাসিমুখে ব্যস্ত বিক্রেতা আর ক্রেতাদের মধ্যে লেনদেনের চিত্র, যেন এক জলরঙে আঁকা শহরদৃশ্য। কার্যালয়ে পৌঁছে নিচতলা থেকে ফ্রেশ হয়ে গেলাম ক্যানটিনে। সেখান থেকে নাশতা করে সভাকক্ষে যেতেই দেখা হলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লেখক বন্ধুদের সঙ্গে। অল্প সময়ের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান।

ভৈরব জংশনে ট্রেনের অপেক্ষায় আমরা।

প্রথমেই বক্তব্য দেন আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। তাঁর একটি বই পড়েছি মাত্র, কিন্তু আজ তাঁর কথা শুনে মনে হলো—কত কিছু জানার বাকি! বললেন, ‘ভালো লেখক হতে চাইলে আগে ভালো পাঠক হতে হবে।’ স্যারের কথা যেন মনের ভেতরে ঢুকে গেল। প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম, হাতও তুলেছিলাম, কিন্তু সুযোগ আর হলো না। এরপর একে একে বক্তব্য দেন কবি কামরুজ্জামান কামু, বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের শাকিব ভাই ও কনটেন্ট সহকারী তাহসিন ভাই। তাঁরা বন্ধুসভার ছাপা পাতা ও ওয়েবসাইটে লেখালেখি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিলেন। এর মাধ্যমেই সমাপ্ত হয় অনুষ্ঠানসূচির প্রথম অধিবেশন এবং শুরু হয় দুপুরের বিরতি।

বিরতির পর বক্তব্য দেন মোহিত কামাল। ক্লান্ত শরীরেও তাঁর কণ্ঠে যেন প্রাণ জেগে উঠল। তিনি বললেন, ‘লিখে যেতে হবে, থেমে গেলে হবে না।’ তাঁর বক্তব্যে যেন ভেতর থেকে লেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এক শক্তি পেলাম। এরপর লেখা প্রকাশ, পত্রিকায় লেখার কৌশল, ওয়েবসাইটে উপস্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করলেন সুবর্ণ, স্বরে অ, নৈঝতা ক্যাফে প্রকাশনা ও অন্য আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক ফিরোজ এহতেশাম। প্রতিটি বক্তব্য আমার জন্য ছিল নতুন জানালার মতো।

সবশেষে এল সেই প্রতীক্ষিত মুহূর্ত—পুরস্কার বিতরণী পর্ব। ‘সেরা লেখক বন্ধু’ নির্বাচিত হলেন পাঁচজন— নূরে জান্নাত, রাসেল রাজ, রশীদ এনাম, সৌরভ আহমেদ ও নাহিদ হোসাইন। যখন রাসেল ভাই ও নাহিদ ভাইয়ের নাম ঘোষণা করা হলো, আমাদের ভৈরব বন্ধুসভার মধ্যে যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। সেই মুহূর্তে কারও মুখে কথা নেই, শুধু উল্লাস আর করতালির গর্জন। ভৈরব বন্ধুসভার জন্য এটি ছিল এক ঐতিহাসিক প্রাপ্তি। যেন আমাদের সম্মিলিত পরিশ্রম আর লেখার প্রতি ভালোবাসার স্বীকৃতি মিলল। তাঁরা দুজন মঞ্চে দাঁড়িয়ে সম্মাননা গ্রহণ করলেও, মনে হচ্ছিল—এই পুরস্কার আমাদের সবার। কেবল ভৈরব বন্ধুসভা নয়, যে ৫ জন বন্ধু সেরা লেখক সম্মাননা অর্জন করেছেন, তা পুরো বন্ধুসভারই অর্জন।

পুরস্কার বিতরণ শেষে সবাই মিলে ছবি তুললাম, অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলাম। মনে হচ্ছিল, এই একটি দিন যেন আমাকে সাহিত্যের নতুন দরজায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। জীবনের অনেক না জানা, না বোঝা, না শেখা অগণিত বিষয় আজকের এই প্রোগ্রাম থেকে শিখে গেলাম। শিখলাম কীভাবে বন্ধু হওয়া যায়, কীভাবে নিজের লেখাগুলোকে পরিশুদ্ধ এবং আত্মার মতো স্বচ্ছ করা যায়, কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবই ছাড়াও শিক্ষা অর্জন করা যায়। কীভাবে প্রেম আর ভালোবাসা দিয়ে সমাজ, দেশ এবং পুরো বিশ্বকে সুন্দর করে এগিয়ে নেওয়া যায়।

প্রথমবারের মতো কোনো কেন্দ্রীয় আয়োজনে অংশগ্রহণ, দেশসেরা লেখকদের কাছ থেকে শেখা আর সাহচর্য পাওয়া—আমার লেখকজীবনের প্রথম বড় অর্জন। দিনটি মনের খাতায় চিরকাল লেখা থাকবে।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা