আইরিশ ভূখণ্ডে বাংলাদেশি ক্রিকেটের নতুন উত্থান

বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক সজল মিত্র রিচার্ড। ঘুরে দেখছেন দেশটির দর্শনীয় সব স্থান। সেসব নিয়ে বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য লিখেছেন তিনি। আইরিশ নৈসর্গিক রূপকথার ধারাবাহিক পর্বের চতুর্থ গল্পে থাকছে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে অবস্থিত ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাবের কথা।

ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাব মাঠের স্কোরবোর্ডছবি: লেখকের সৌজন্যে

স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্ত। পৃথিবীর সবুজ সৌন্দর্য দেখা ও ইতিহাস জানার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময়তার আড়ালে বাংলার ক্রিকেটীয় মাধুর্য।

ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাব মাঠে খেলা চলছে। বলে আগের মতো গতি নেই, রানআপ নেওয়ার মতো শারীরিক কাঠামোও নেই, ব্যাটিংয়েও যৌবনের সেই জৌলুশ আজ ফিকে। তারপরও চলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এসব না থাকলেও এই খেলায় বিনোদনের কমতি নেই। শারীরিকভাবে খেলার দক্ষতায় ভাটা পড়লেও সবাই মানসিকভাবে চাঙা। শারীরিক দক্ষতায় ভাটা পড়াটা অবশ্যই স্বাভাবিক। সবাই সাবেক ক্রিকেটার।

আয়ারল্যান্ডপ্রবাসী সাবেক ক্রিকেটাররা লাল ও নীল দুই দলে ভাগ হয়ে খেলছেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। ফলাফলেও প্রভাব স্পষ্ট। দুই ম্যাচের সিরিজ ড্র। দুই দলই জিতেছে একটি করে ম্যাচ। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চেও ছিল উল্লাস আর হইহুল্লোড়ের ডামাডোল। ক্রিকেট যেন মেলবন্ধনের সূত্রধর। ক্রিকেট বাঙালির যাপিত জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে একটুখানি বিনোদনের ফুরসত। ম্যাচের গল্প ছাপিয়ে এবার ভেন্যু ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাবের রচনাসমগ্র খুলতে চাই।

আরও পড়ুন

ডাবলিন শহরের ব্যস্ত জীবনযাত্রার মধ্যেও ক্রিকেটের প্রতি যে অদ্ভুত টান কাজ করে, তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাব। ২০১৫ সালে জন্ম নেওয়া এই ক্লাব এখন শুধু একটি খেলার জায়গা নয়, বরং স্থানীয় সমাজে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং ঐক্যের প্রতীক। অল্প সময়ের মধ্যে তারা যেভাবে মাঠে সাফল্য অর্জন করেছে এবং মাঠের বাইরে সমাজে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে, তা নিঃসন্দেহে ডাবলিনে ক্রিকেটের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে, যার পুরোটাই মূলত স্থানীয় বাংলাদেশিদের সৃষ্টি।

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল ক্লাবটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় টায়মন পার্কের লিমেক্লিন এলাকায়। যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আয়ারল্যান্ডের তৎকালীন ন্যায় ও সমতার মন্ত্রী ফ্রান্সেস ফিৎসজেরাল্ড। সেই দিনটি শুধু একটি নতুন ক্লাবের জন্ম নয়, বরং ডাবলিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ক্রিকেটকে ফিরিয়ে আনার এক নতুন সূচনা হিসেবে দেখা হয়েছিল। উদ্বোধনের পরপরই ক্লাব যোগ দেয় সাউথ ডাবলিন কাউন্টি পাবলিক পার্টিসিপেশন নেটওয়ার্কে (এসডিসিপিপিএন)। যা তাদের সমাজমুখী কাজকে আরও সুসংগঠিত করে। শুরুর দিকে হাতে গোনা কয়েকজন খেলোয়াড় আর অল্প কিছু সরঞ্জাম নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল। আজ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক শক্তিশালী ক্রিকেট প্রতিষ্ঠান, যার সদস্যসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাব মাঠে খেলা চলছে। আয়ারল্যান্ডপ্রবাসী সাবেক ক্রিকেটাররা লাল ও নীল দুই দলে ভাগ হয়ে খেলছেন
ছবি: লেখক

প্রথম কয়েক বছরেই ক্লাব সাফল্যের স্বাদ পেতে শুরু করে। ২০১৬ সালে তারা সম্মানজনক ডাবলিন বাস কমিউনিটি স্পিরিটি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। একই বছর সাউথ ডাবলিন কাউন্টি কাউন্সিলের কমিউনিটি এনডিয়েভোর্স অ্যাওয়ার্ডের জন্যও তালিকাভুক্ত হয়। স্বীকৃতিগুলো শুধু খেলাধুলার ময়দানেই নয়, বরং সমাজ উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রমাণ দেয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে আসে মাঠের বড় অর্জন। ক্লাবের প্রথম দল জয় করে হুইলান টি-২০ কাপ ট্রফি, যা তাদের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে।

২০১৮ সালে সাফল্যের পালকে যুক্ত হয় মাইনর কাপ ২। এ বছর ক্লাবের দ্বিতীয় দল নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় শিরোপা জয় করে। ২০১৯ সালে আসে আরেকটি বড় সাফল্য, ডিভিশন ৯ লিগ জয়ের মাধ্যমে। এই জয় ক্লাবের অভিজ্ঞতা, শৃঙ্খলা ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ক্লাবের প্রথম দল মিডল কাপ টি-২০ জিতে নেয়, যা প্রমাণ করে তারা এখনো সমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম।

সাফল্যের পেছনে শুধু স্থানীয় সমর্থকদের অবদান আছে তা নয়, বরং রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অক্লান্ত পরিশ্রমও। ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাবকে বর্তমানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট মো. মোস্তফা এবং চেয়ারম্যান চুন্নু মাতবর। তাঁদের হাত ধরেই ক্লাবটি নতুন গতিতে এগোচ্ছে। আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশিরা এই ক্লাবের মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছেন। তাঁরা শুধু খেলোয়াড় হিসেবেই নয়, সংগঠক হিসেবেও ক্লাবের প্রতিটি স্তরে ভূমিকা রাখছেন।

তাঁদের লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী—শুধু স্থানীয় পর্যায়ে ক্রিকেট জনপ্রিয় করা নয়, বরং আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেট অঙ্গনে বাংলাদেশের ক্রীড়া সংস্কৃতির ছাপ রেখে যাওয়া। তাঁদের কণ্ঠে একটাই প্রত্যয়—আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেট আঙিনায় চলুক বাংলাদেশের রাজত্ব, আইরিশ ক্রিকেট বাগানে বিচরণ করুক বাংলাদেশের টাইগাররা। যাঁদের অদম্য প্রচেষ্টা ও আত্মবিশ্বাসে বিশ্ব ক্রিকেট ইতিমধ্যেই লাল-সবুজের পতাকাকে গৌরবান্বিত করেছে, সেই ধারা আয়ারল্যান্ডের মাটিতেও বয়ে আনতে চান তাঁরা। ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাবের সাফল্যের গল্পে তাই বাংলাদেশিদের অবদান আজ অবিচ্ছেদ্য।

সাফল্যের পেছনে শুধু স্থানীয় সমর্থকদের অবদান আছে তা নয়, বরং রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অক্লান্ত পরিশ্রমও
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এত সব অর্জনের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে ক্লাবের সদস্যসংখ্যাও বেড়েছে। ২০১৫ সালে যেখানে কয়েকজন খেলোয়াড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন সেখানে রয়েছে ৫৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য এবং ২২ জন শিশু-কিশোর সদস্য। ক্লাব শিশুদের উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। প্রাথমিক স্তরে ছোট ছোট ক্রিকেটপ্রেমী কিশোরদের হাতে ব্যাট তুলে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের শারীরিক, মানসিক ও কৌশলগত বিকাশে সমানভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়। এমনকি উন্নত সুবিধা তৈরির জন্য ক্লাব ধারাবাহিকভাবে তহবিল সংগ্রহ করে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে প্র্যাকটিস নেটস, সুরক্ষা ফেন্সিং এবং আধুনিক ব্যাটারিচালিত বোলিং মেশিনের মতো সরঞ্জাম, যা ভবিষ্যতের খেলোয়াড়দের প্রস্তুত করতে বিশেষভাবে সহায়ক।

ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাবের সাফল্যের পেছনে মূল চালিকা শক্তি তাদের মিশন ও মূল্যবোধ। তারা মনে করে ক্রিকেট কেবল একটি খেলা নয়, বরং এটি মানুষের মধ্যে বন্ধন গড়ে তোলার এক অসাধারণ মাধ্যম। তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করতে; যেখানে জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি কিংবা বয়স নির্বিশেষে সবাই সমান সুযোগ পাবে। ভিশন হলো ক্রিকেটকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমির খেলোয়াড়দের জন্য একত্রিত হওয়ার মঞ্চে পরিণত করা। এ কারণেই এখানে যেমন স্থানীয় আইরিশ তরুণেরা খেলছেন, তেমনি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা ক্যারিবিয়ান প্রবাসীরাও একই জার্সি পরে একসঙ্গে মাঠে নামছেন। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে একধরনের সামাজিক সংহতি তৈরি হয়েছে, যা আজকের বিশ্বায়িত সমাজে এক মূল্যবান বার্তা বহন করে।

ক্লাবের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা কোচিং প্রোগ্রাম রয়েছে, যেখানে তারা খেলার মৌলিক কৌশল শেখে এবং ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতামূলক মানে উন্নীত হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রয়েছে দুটি ধাপ—প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট এবং বিনোদনমূলক ক্রিকেট। এর ফলে যাঁরা পেশাদারভাবে ক্রিকেটে এগোতে চান, তাঁরা সুযোগ পাচ্ছেন; আবার যাঁরা শুধু সপ্তাহান্তে আনন্দের জন্য খেলতে চান, তাঁরাও সমানভাবে জায়গা পাচ্ছেন। নিয়মিত প্রশিক্ষণ সেশনে শুধু টেকনিক নয়, শারীরিক ফিটনেস, মানসিক প্রস্তুতি এবং কৌশলগত চিন্তাধারায়ও জোর দেওয়া হয়।

সুবিধার দিক থেকেও ক্লাব এখন অনেক এগিয়েছে। আধুনিক ক্লাবহাউস, সজ্জিত চেঞ্জিং রুম, ফ্রি পার্কিং, যত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করা পিচ এবং উন্নত সরঞ্জামসহ প্র্যাকটিস এরিয়া—সব মিলিয়ে ক্লাব এখন আন্তর্জাতিক মানের একটি অনুশীলন পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এটি নতুন খেলোয়াড়দের আকৃষ্ট করছে এবং সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে।

আরও পড়ুন

বর্তমানে ক্লাবের রয়েছে তিনটি দল, যারা ডিভিশন ৭, ডিভিশন ১২ ও ডিভিশন ১৪-তে খেলছে। দক্ষতার ভিত্তিতে খেলোয়াড়দের এক দল থেকে আরেক দলে উন্নীত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যাতে প্রত্যেকে তাদের সর্বোচ্চ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে। ক্লাবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবাসী ক্রীড়া সংগঠক মো. মোস্তফা ও চুন্নু মাতবরের পাশাপাশি রয়েছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতিমান আইরিশ সংগঠক কেনেথ ইগান। এই সমন্বয় ক্লাবকে আরও শক্তিশালী করছে।

ডাবলিনের হৃদয়ে জন্ম নেওয়া এই ক্লাব প্রমাণ করেছে, অল্প সময়ে কঠোর পরিশ্রম ও সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। ক্লোনডালকিন ক্রিকেট ক্লাবের গল্প আসলে এক নবজাগরণের গল্প, যেখানে ক্রিকেট শুধু ব্যাট-বল নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। তাই বলা যায়, এই ক্লাব আজ ডাবলিনে ক্রিকেটের নতুন উত্থানের আলোকবর্তিকা, যেখানে লাল-সবুজের পতাকা গর্বের সঙ্গে উড়ছে আয়ারল্যান্ডের আকাশে।

সব দেখলাম, খেললাম, ঘুরলাম—এরপর আড্ডা জমে উঠল সন্ধায়। চা-কফির সঙ্গে লোভনীয় পিজ্জা। আনন্দ উপভোগের কমতি নেই। এবার ফেরার পালা। প্রকৃতির সবুজকে আরও একবার আলিঙ্গন করে দেশের ক্রিকেটের ঘ্রাণ পেলাম আইরিশ মাটিতে। ফেরার সময় হওয়ায় মনটা খারাপ হতে বাধ্য।

ওয়েস্টমিথ কাউন্টি, আয়ারল্যান্ড