ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রাতের বাসে ওঠা অবধি আবহাওয়া ঠিকঠাক। ঘাটে আমাদের জন্য হাউসবোট ‘জমিদার’ অপেক্ষা করছে। সবাই মিলে সাতজনের একটা দল। গত বছর ঠিক এই সময়ে একসঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জুলাইয়ের সেই বিভীষিকাময় ভয়ার্ত সময়ে আর বের হওয়া সম্ভব হয়নি। প্রীতি ও সুমনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দুজনের মুখে একই কথা, ‘অবশেষে আমরা হাওরে যাচ্ছি তাহলে’।
সিলেটের সীমানায় বাস ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ যেন বদলে গেল। নগরীর ভ্যাপসা গরম ধুয়েমুছে সাফ করে রেখেছে শ্রাবণের বৃষ্টি। হাওরকন্যা নামে পরিচিত সুনামগঞ্জে বাস থেকে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই নামতে হলো। ডিঙিনৌকা কিংবা ছোট ট্রলারে হাওরে ঘুরলেও হাউসবোটে এই প্রথমবার। এটা দেখে মনে হলো, এ যেন আস্ত ঘর। কী নেই এর মধ্যে? রান্নাঘর থেকে শুরু করে আধুনিক ওয়াশরুম সবই রয়েছে। যৌথ পরিবারের মতো বোটের লবিতেই সবাই মিলে সকালের নাশতা খেলাম। বোট ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। খাওয়াদাওয়া শেষে যে যার মতো সময় কাটাচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি, চায়ের কাপ হাতে জানালা দিয়ে অবাক হয়ে বৃষ্টির নাচ উপভোগ করছে। জলের ওপর কী সুন্দর সুর তুলেছে! হাঁসেরা মেতেছে জলডুব খেলায়। ছোট ছোট গ্রামগুলো যেন একেকটা দ্বীপ।
‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’—এ ঘণ্টা তিনেকের পথ পেরিয়ে শিমুলবাগান পৌঁছালাম দুপুরের দিকেই। তখনো বৃষ্টি থামেনি, তবে কমেছে। নামার সময় ঘাটে ছাতা নিয়ে ছোট ছোট অনেক পিচ্চি ভিড় জমিয়েছে। বলছে, ‘ছাতা লাগবে? ছাতা নেন, আমারটা ভালো, ওরটা ভাঙা...’ ব্যাপারটা এমন যে আমি দিচ্ছি বৃষ্টিতে মাথা বাঁচানোর সেরা ছাতা। আমারটাই নিন। কেউ আবার ফুল, বাদাম এসব নিয়েও এসেছে। অবশ্যই বিনিময় মূল্য আছে। ১০, ২০ ও ৩০ টাকা আবার কেউ কেউ ৫০ টাকা পর্যন্ত দাবি করে বসে। আমরা তিনটা ছাতা নিয়ে শিমুলবাগানে ঢুকে গেলাম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সবুজ যেন আরও সবুজ হয়ে উঠেছে।
সেখান থেকে গেলাম মেঘালয়ের কাছাকাছি যাদুকাটা নদী ধরে বারিক্কাটিলার দিকে। দেখা পেলাম অপার্থিব সৌন্দর্যের। পাহাড়, কালো মেঘ, দূরের ঝরনা আর বাতাস। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। কবিতার মতো সুন্দর নেমে এসেছিল মেঘালয়ের নিচে আমাদের বোটের ওপরে। বোট যতটা পারা যায় কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে মেঘালয়ের। সবাই মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করেছে। সুমন ও আরিফা তো গানের দুনিয়ায় ভেসে গিয়েছে তখন। এমন দৃশ্য কত দিন পরপর দেখা যায়, তা জানি না। সেখান থেকে অনেকটা আফসোস নিয়েই ফিরতে হয়। যদি বাকিটা সময় এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যেত!
তখনো নীলাদ্রি দেখা বাকি। নীল পানির কন্যাকে তো রাগ করতে দেওয়া যায় না। সন্ধ্যার আগমুহূর্তে লিলুয়া বাতাস গায়ে এসে লাগছিল। উকিল মুনশির সেই বিখ্যাত গানের কথা মনে পড়ছিল, ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে পুবালি বাতাসে’। নীলাদ্রি পানিতে ডুবুডুবু। কাছাকাছি পৌঁছাতে গিয়ে চোখের সামনেই কয়েকজন পিচ্ছিল রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে ফেলেছে। তবু থেমে নেই। প্রিয় মানুষের হাত ধরে সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছিল কেউ কেউ। সীমান্ত পাহাড়ের গায়ে তখনো বৃষ্টি পড়ছে। রাতে হাওরের নীরবতা ভাঙতে বোটে জমে গানের আসর। নতুন ও পুরোনো সব গান উঠে আসছে একেক করে। পাশের বোট থেকেও সমানতালে ভেসে আসে সুর, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়’। এক রাতের জন্য হাওরে সবাই আপন, সবাই পরিচিত।
পরদিন সকালে আবার টাঙ্গুয়ার ওয়াচ টাওয়ারের দিকে যাত্রা। সঙ্গী সেই শ্রাবণের বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি। এবার আর কেউ আটকাতে পারেনি নিজেকে। সবাই বোটের ছাদে বৃষ্টির বন্দনায়। দ্বীপ গ্রামগুলোর কাছ দিয়ে আসার সময় অনেকেই হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল। বর্ষায় নৌকাতেই যাদের ভরসা। হাওরের থই থই পানি আর বৃষ্টি মিলে একাকার অবস্থা। মাথা ভাসিয়ে গলাপানিতে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল–করচের বন। হাওরের নীরবতা লেগে থাকে আমাদের চোখে; সঙ্গে জলের ওপর বৃষ্টির অবিরাম সুর। আবার ফিরতে হয় নগরীর কোলাহলে। হাতে লেগে থাকে হাঁসের সালুনের ঘ্রাণ।
আদাবর, ঢাকা