ইতিহাস যখন প্রকৃতির কথা বলে
বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক সজল মিত্র রিচার্ড। ঘুরে দেখছেন দেশটির দর্শনীয় সব স্থান। সেসব নিয়ে বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য লিখেছেন তিনি। আইরিশ নৈসর্গিক রূপকথার ধারাবাহিক পর্বের তৃতীয় গল্পে থাকছে আয়ারল্যান্ডের মিডল্যান্ডে অবস্থিত ডুন না সি পার্কের কথা।
এ যেন এক স্বপ্নের রাজ্য। পৃথিবীর সবুজ সৌন্দর্য দেখা ও ইতিহাস জানার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐতিহাসিক জ্ঞানের আধার নিয়ে পরিবেষ্টিত এলাকাটি।
ডুন না সি পার্ক একটি আইরিশ শব্দ, যার বাংলা অর্থ ‘পরির দুর্গ’ বা পরিদের বাসস্থান। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এখানে শুধু পরিরাই বাস করে। আইরিশরা পরিদের ঈশ্বরের পাঠানো পবিত্র দূত বলে মনে করে। আর পার্কটিতে আইরিশ বাচ্চারা তাদের অবসর সময় কাটায়। বাচ্চাদের সঙ্গে পরিদের পবিত্রতার তুলনা অর্থেই এ নামকরণ করা হয়েছে। এটি আয়ারল্যান্ডের একেবারে মধ্যাঞ্চলে ওয়েস্টমিথের মোউট শহরের কাছে অবস্থিত। প্রায় ২৭ একরের সুবিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা।
২০০৭ সালে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের একটি দল মিডল্যান্ড অ্যামেনিটি পার্ক সিএলজি স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে ১০০ বছরের খুবই স্বল্প ভাড়ায় একটি কাউ পার্কের লিজ নিয়ে সেখানে নতুন করে নয়নাভিরাম পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন পূর্বে এই পার্কের জায়গার নাম ছিল ‘কাউ পার্ক’। ২০১৩ সালে স্থানীয় কাউন্টির নেতৃবৃন্দের সৌজন্যে পাওয়া অর্থসহ প্রায় এক মিলিয়ন ইউরো তহবিল সংগৃহীত হয়। যার মাধ্যমে ২০১৫ সালে পার্কটি নতুন করে ‘ডুন না সি অ্যামেনিটি অ্যান্ড হেরিটেজ পার্ক’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
পার্কটিতে রয়েছে আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনন্য সংরক্ষণাগার। হেরিটেজ ট্রায়াল নামে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসব ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক ডলমেন (আইরিশ পুতুল), রিংফোর্ট (চাষের জমির ময়দান), পাথরবৃত্তের (পাথর আবৃত উঠোন) পাশাপাশি দেখা মিলবে উনিশ শতকের কৃষকবাড়ি, ব্ল্যাকস্মিথ ফর্জ (শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখার বিশেষ পদ্ধতি), পানি উত্তোলনের যন্ত্র, বিশেষভাবে তৈরি পানির কুয়ো, মাছওয়ালার কুটির (জেলেদের বাসস্থান), হেজ-স্কুল (প্রাচীন পদ্ধতিতে পাঠদানের স্কুল), বিভিন্ন আকৃতি ও ধরনের ব্যবহৃত দড়ি ইত্যাদি বিষয়কে খুবই সুন্দর ও বিশদভাবে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় সবকিছুর বিশদ বিবরণ দেওয়ার জন্য ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করে দর্শনার্থীদের বোঝানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
পার্কটিকে যেমন ইতিহাস সংরক্ষণের কাজে লাগানো হয়েছে, ঠিক তেমনি আইরিশ সংস্কৃতি উদ্যাপনেও ব্যবহার করা হয়। আইরিশ কালচারাল সেন্টার ও জেনিয়ালজি সেন্টারের উদ্যোগে বয়সভিত্তিকভাবে শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নাগরিকদের জন্য গানের কোর্স ও র্যাম্বলিং হাউসের (নাচের ক্লাস) আয়োজন করা হয়। এসব প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আইরিশরা শিশুদের সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে। পাশাপাশি এখানে রয়েছে একটি পোষা প্রাণীর ফার্ম, সেনসরি গার্ডেন (ফুল ও সবজির বাগান), বিশাল আকৃতির খেলার মাঠ, পানির বিশেষ ফোয়ারা, কাঠ দিয়ে তৈরি বিশেষ কাঠামোর জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং একটি পানির লেক (ল্যায-ইয়ান লেক)। গ্রীষ্মকালে লেকের পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মেলে, যা আপনাকে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
দর্শনার্থীদের জন্য ভেতরেই রয়েছে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা। ‘ব্যসসন কিচেন ক্যাফে’ নামের রেস্টুরেন্টটিতে সব সুবিধাই পাওয়া যায়, যা ভ্রমণপিপাসুদের ক্লান্তি দূর করার পাশাপাশি চা-কফি পানের মাধ্যমে চাঙা হওয়ারও সুযোগ করে দেয়। রেস্টুরেন্টের সামনেই রয়েছে বাচ্চাদের খেলাধুলা করার সুব্যবস্থা। বাঁ পাশে গোলাপের বাগান। চা পানের জন্য এর চেয়ে আর ভালো পরিবেশ কী হতে পারে!
পার্কটি বিশাল আকৃতির। সবার সুবিধার জন্য এই পার্কের ঐতিহ্য ও তথ্যবহুল স্থানগুলোকে একীভূত করে দর্শনার্থীদের জন্য একটি মাল্টি-ল্যাংগুয়েজ অ্যাপ চালু করেছে কর্তৃপক্ষ। অ্যাপটিকে চাইলেই বিভিন্ন ভাষায় পরিচালিত করা যায়। ইংরেজি, আইরিশ, স্প্যানিশ, জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ান ভাষায় অ্যাপটি চালু রয়েছে। বিদেশি ভ্রমণপিপাসু নাগরিকদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এটি ২০২২ সাল থেকে চালু করেছে কতৃপক্ষ। যা দিয়ে পার্কের ১০টি স্পটের বিবরণ ও ঐতিহাসিক গল্পগুলোর ব্যাখ্যাও জানা যায় খুব সহজেই।
পার্কটি স্থানীয় কমিউনিটির সক্রিয় উদ্যোগে যাত্রা শুরু করলেও ২০১৮ সালে এসে বেতনভুক্ত কর্মচারী নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করে। যা পরিচালনায় যোগ করে প্রশাসনিক মাত্রা। ২০২৪ সালে ডুন না সি পার্ককে কাউন্টি শ্রেণিতে প্রাইড অব প্লেস হিসেবে কমিউনিটি ট্যুরিজম ইনিশিয়েটিভ ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত করে আইরিশ সরকার।
ট্যুরিজমের পাশাপাশি পার্কটিতে বিভিন্ন রকমের সামাজিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। যেমন—তরতাজা সবজির মেলা, গ্রামীণ কারুকার্যের প্রদর্শনী; যেখানে থাকে রঙের কারুকার্য, বাঁশের তৈরি জিনিসের মেলা, চামড়ার তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মেলা। এ ছাড়া, বিভিন্ন কমিউনিটি উৎসব, নৃত্য, সংগীত, খাবার, আর্ট, এক্সিবিশনসহ প্রায় সারা বছরই কিছু না কিছু অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এখানের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক নিদর্শন হচ্ছে নারীর স্বাধীনতার নিদর্শনস্বরূপ স্থাপিত নোলানের প্রতিমূর্তি। পতাকা হাতে নোলানকে আইরিশ নারীদের অগ্রযাত্রার অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়।
স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাব এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এখানে আয়োজন করে নানা ধরনের উপভোগ্য অনুষ্ঠানমালা। সব দেখলাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ আর একরাশ প্রাগৈতিহাসিক বিষয় চোখের সামনে ভাসল। মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম কয়েক ঘণ্টা। এবার ফেরার পালা। প্রকৃতি আর ইতিহাসের এই সংমিশ্রণ না দেখলে আসলে বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ওয়েস্টমিথ কাউন্টি, আয়ারল্যান্ড