গ্যালওয়ের সমুদ্রতীরে ইতিহাসের গান আর সূর্যাস্তের কবিতা

বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক সজল মিত্র রিচার্ড। ঘুরে দেখছেন দেশটির দর্শনীয় সব স্থান। সেসব নিয়ে বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য লিখেছেন তিনি। আইরিশ নৈসর্গিক রূপকথার ধারাবাহিক পর্বের পঞ্চম গল্পে থাকছে আয়ারল্যান্ডের গালওয়ের সল্টহিল সমুদ্রসৈকতের কথা।

আয়ারল্যান্ডের গালওয়ের সল্টহিল সমুদ্রসৈকতে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে লেখকছবি: লেখকের সৌজন্যে
আটলান্টিক মহাসাগরের ঢেউ যখন গ্যালওয়ের তীরে আছড়ে পড়ে, তখন তার ছন্দে শোনা যায় পুরোনো দিনের গল্প।

সৌন্দর্যের রাজ্যের রাজকন্যা বললে কি একেবারে ভুল হবে? হয়তো একেবারেই না। আটলান্টিক পারের নীল জলরাশির সৌন্দর্য দেখার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সামনে এক আকাশের নীল আর স্বচ্ছ জলের জলকেলি।

খুব সকালে উঠেই পরিবার নিয়ে রওনা হলাম ওয়েস্টমিথ থেকে। উদ্দেশ্য গালওয়ের নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত সল্টহিল দেখা। আটলান্টিকের পারে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশের সুদূর প্রান্তে মিশে যাওয়া জলরাশির সঙ্গে কুশল বিনিময় করা। বাসে ঘণ্টা দেড়েকের রাস্তা। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে আনন্দ করতে করতেই পৌঁছে গেলাম প্রকৃতির অপরূপ কন্যা সল্টলেকের দরজায়।

আয়ারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের শহর গ্যালওয়ে—যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর সমুদ্রের গর্জন মিলে গড়ে তুলেছে এক অনন্য জগৎ। গ্যালওয়ের বুকে রয়েছে এক রত্নভান্ডার, নাম সল্টহিল। আইরিশ ভাষায় পরিচিত ‘বদার না ট্রা’, অর্থাৎ সৈকতের পথ। কিন্তু বাস্তবে সল্টহিল কেবল একটি পথ নয়—এটি প্রকৃতির কবিতা, মানুষের ইতিহাস আর ভ্রমণকারীর অনন্ত মুগ্ধতার কেন্দ্র।

আটলান্টিক মহাসাগরের ঢেউ যখন গ্যালওয়ের তীরে আছড়ে পড়ে, তখন তার ছন্দে শোনা যায় পুরোনো দিনের গল্প। ১৮১৯ সালের আগে অঞ্চলটির নাম ছিল সল্টহিল। তখনো এটি একটি নিভৃত সমুদ্রপার, যেখানে কেবল জেলেরা আর স্থানীয় বাসিন্দাদের পদচিহ্ন থাকত।

১৮৩১ সালে চিকিৎসক রবার্ট রজার্স গ্রে এখানে স্থাপন করেন ঔষধি স্নানাগার। অসুস্থতা দূর হবে—এই আশায় বহু মানুষ ভিড় জমাত সেখানে। যদিও ১৮৭০ সালে অগ্নিকাণ্ডে সেই স্নানাগার ধ্বংস হয়ে যায়, তবু সল্টহিলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ থেমে থাকেনি। বরং আরও বেড়েছে।

১৮৫৬ সালে তৈরি হয় সল্টহিল প্রমেনেড, দীর্ঘ সেই সমুদ্রতীরবর্তী হাঁটার পথ। প্রমেনেড যেন সময়ের সেতুবন্ধ—গত দেড় শতাব্দী ধরে যেখানে একইভাবে প্রতিদিন মানুষ হেঁটে চলেছে, শ্বাস নিয়েছে সমুদ্রের লোনা হাওয়ায়। প্রমেনেডের শেষে দাঁড়িয়ে থাকা ব্ল্যাকরক ডাইভিং টাওয়ার, ১৯৫৩ সালের সাক্ষী। আজও সাহসী ভ্রমণকারীরা সেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন উত্তাল আটলান্টিক জলে। আরেকটি অদ্ভুত ঐতিহ্য হলো—হাঁটার শেষে দেয়ালে টোকা দেওয়া। বলা হয়, এটি সৌভাগ্যের প্রতীক।

গ্যালওয়ের সমুদ্রতীর
ছবি: লেখক

সল্টহিলে গেলে বোঝা যায় কেন গ্যালওয়ে বে-কে কবিরা এত ভালোবেসেছেন। দিনের বিভিন্ন প্রহরে সমুদ্র তার রূপ পাল্টায়। ভোরে নরম আলোয় স্নিগ্ধ, দুপুরে ঝলমলে নীল আর সন্ধ্যায় লালচে সূর্যাস্তে মোহনীয়। প্রমেনেড ধরে হাঁটতে হাঁটতে একদিকে চোখে পড়ে দূরের বারেন পাহাড়শ্রেণি, অন্যদিকে আবছা ভেসে ওঠে আরান আইসল্যান্ড। বাতাসে ভেসে আসে সাগরের গন্ধ, আর দূর থেকে শোনা যায় তরঙ্গের সংগীত।

সল্টহিলের সৈকত পেয়েছে ব্লু ফ্লাগ মর্যাদা—যা পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশরক্ষার প্রতীক। গ্রীষ্মকালে সৈকতজুড়ে উৎসবমুখর ভিড়; কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ রোদ পোহাচ্ছে, কেউ–বা কেবল হাঁটছে। আর শীতে সমুদ্রের নির্জন সৌন্দর্য ভ্রমণকারীর মনে অন্য রকম প্রশান্তি এনে দেয়।

সল্টহিল শুধু প্রকৃতির আঁকা ছবি নয়, এর ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে মানুষের সৃজনশীলতার চিহ্ন। ১৮১৭ সালে নির্মিত মাটন আইসল্যান্ড লাইট হাউস আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। আর ২০১২ সালে গড়ে ওঠা গালওয়ে ফ্যামিন শিপ মেমোরিয়াল আমাদের মনে করিয়ে দেয় দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট অতীতের বেদনাময় গল্প। যে দুর্ভিক্ষের কারণে ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সালে আইরিশদের ফসল নষ্ট হয়েছিলে। খাবারের অভাবে ২০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল। মারা গিয়েছিল ১০ লাখ মানুষ। তাদের অনেকেরই নাম–সংবলিত স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে এই গালওয়ে ফ্যামিন শিপ মেমোরিয়ালে, যা পুরো আইরিশ জাতির জন্যই স্মৃতিকাতর দুঃখগাথা।

আরও পড়ুন

শুধু ইতিহাস নয়, সল্টহিল ক্রীড়ার জন্যও বিশেষ করে ফুটবলে সমান বিখ্যাত। সল্টহিল নকনাকারা জিএএ ক্লাব ২০০৬ সালে অল-আয়ারল্যান্ড শিরোপা জিতেছিল, যা স্থানীয়দের গর্বের স্মৃতি। ফুটবলে সল্টহিল ডেভন এফসিও আঞ্চলিক সাফল্য কুড়িয়েছে অসংখ্যবার।

একসময় এখানে ছিল ক্লাড্ডাহ প্যালেস সিনেমা হল। ১৯৩৯ সালে যাত্রা শুরু করা সেই সিনেমা হল বহু দশক ধরে মানুষের বিনোদনের কেন্দ্র ছিল। যদিও ১৯৯৫ সালে পর্দা নেমে যায়, আজও স্থানীয় লোকজন আবেগ নিয়েই তার নাম স্মরণ করে।

ভ্রমণের আনন্দ দ্বিগুণ হয় যখন থাকে ভালো খাবার ও অবসর কাটানোর জায়গা। সল্টহিলে সেটিরও অভাব নেই। প্রমেনেডের পাশেই রয়েছে ব্ল্যাকরক কটেজ—একটি পুরোনো কটেজ, যেটি এখন রূপ নিয়েছে জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টে। এখানকার স্থানীয় খাবার যেমন মন ভরায়, তেমনি জানালার বাইরে সমুদ্রের দৃশ্যও চোখ জুড়ায়। আমরা অবশ্য নিজেদের খাবার হিসেবে রান্না করা চিকেন খিচুড়ি সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছিলাম। খোলা আকাশের নিচে সাগরপারে বসে দুপুরের গরম খাবার, সেটিও প্রিয় পরিবারের সঙ্গে, এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত জীবনে খুব কমই আসে।

সল্টহিল শুধু ভ্রমণ নয়, এটি এক অভিজ্ঞতা; যা একবার হৃদয়ে গেঁথে গেলে আর কখনো মুছে যায় না
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আরও আছে লেইসারল্যান্ড কমপ্লেক্স—যেখানে সুইমিংপুল, জিম ও নানা বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। পরিবার কিংবা বন্ধুদের নিয়ে ভ্রমণে এ যেন অতিরিক্ত আনন্দের সংযোজন।

সল্টহিলকে ভ্রমণকারীরা বর্ণনা করেন ‘শান্ত অথচ রঙিন’। গুগল রিভিউতে এটি ৪.৮/৫ রেটিং পেয়েছে। এক পর্যটক লিখেছেন—‘সমুদ্রতীর এত পরিষ্কার আর প্রমেনেড এত দীর্ঘ—হাঁটতে হাঁটতে সময়ের হিসাব হারিয়ে যায়।’ আরেকজনের মন্তব্য—‘শিশুদের সঙ্গে আসার জন্য এটি নিরাপদ ও আনন্দদায়ক জায়গা।’ তবে কেউ কেউ বলেছেন, গ্যালওয়ে শহরের কেন্দ্রের তুলনায় এখানে রাতের বিনোদন কিছুটা কম। কিন্তু প্রকৃতি ও প্রশান্তি খোঁজার জন্য সল্টহিলের তুলনা নেই।

হোটেলগুলো নিয়েও পর্যটকদের মতামত ইতিবাচক। সল্টহিল হোটেলের এক অতিথি মন্তব্য করেছেন—‘স্টাফরা আন্তরিক, সকালের নাশতা সুস্বাদু, আর জানালা দিয়ে দেখা গ্যালওয়ে বে-এর দৃশ্য মনে গেঁথে গেছে।’

সল্টহিল কেবল একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়; এটি আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এখানে হাঁটতে হাঁটতে যেন অনুভূত হয় এক চিরন্তন কবিতা, যেখানে প্রতিটি ঢেউ উচ্চারণ করে অতীতের কথা আর প্রতিটি বাতাসে ভেসে আসে ভবিষ্যতের আশা। একদিকে দুর্ভিক্ষের স্মৃতিস্তম্ভ, অন্যদিকে প্রমেনেডের আনন্দময় ভিড়—সল্টহিল যেন জীবনের দ্বৈত রূপের প্রতিচ্ছবি।

আরও পড়ুন

যাঁরা আয়ারল্যান্ড ভ্রমণে আসবেন, তাঁদের জন্য সল্টহিল হলো এক অনিবার্য গন্তব্য। ইতিহাসপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেমী কিংবা শুধু শান্তি খুঁজে বেড়ানো পর্যটক—সবাই এখানে খুঁজে পাবেন নিজের মতো এক আকাশ।

সল্টহিলের সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে যখন সূর্যাস্ত দেখা যায়, তখন বোঝা যায় কেন এই স্থান এত জনপ্রিয়। আকাশের লাল আভায় সাগর যখন সোনালি হয়ে ওঠে, তখন মনে হয়—এই মুহূর্তের জন্যই পৃথিবীতে আসা। সল্টহিল তাই শুধু ভ্রমণ নয়, এটি এক অভিজ্ঞতা; যা একবার হৃদয়ে গেঁথে গেলে আর কখনো মুছে যায় না।

সব ঘুরলাম, দেখলাম। সাগরপারের হাওয়া উপভোগের নেশায় একেবারে বুঁদ হয়েছিলাম কয়েকটি ঘণ্টা। এবার ফেরার পালা। সেখান থেকেই ফিরতি যাত্রায় আবারও ওয়েস্টমিথ। ভালো লাগার কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে মহাসড়ক ধরে ফিরছি, সঙ্গে ভালোবাসার মানুষ আর আমাদের একমাত্র সন্তান। সাগরকে বিদায় দেওয়ার পর রাস্তার দুপাশের সবুজ প্রকৃতি আমাদের বরণ করেছে। মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলছি। দিনটা কাটল অসাধারণ।

ওয়েস্টমিথ কাউন্টি, আয়ারল্যান্ড