পায়ের টানে হেঁটে বেড়িয়েছি, হৃদয়ের আহ্বানে ছুটে গিয়েছি

ভ্রমণ হলো অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি, মানুষ আর অনুভবের এক অনন্য মিশেলছবি: লেখকের সৌজন্যে

বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ঘুরে ফেলেছি ৪৮টি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলি, পায়ের টানে হেঁটে বেড়িয়েছি, হৃদয়ের আহ্বানে ছুটে গিয়েছি। কখনো কাজের প্রয়োজনে, কখনো বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ পরিকল্পনা করে, কখনো-বা শুধুই একাকী ভ্রমণের আনন্দে। ভোরে উঠে ট্রেন ধরা, লঞ্চের ডেকে রাত কাটানো, কিংবা লোকাল বাসে ধুলা মেখে গ্রামে পৌঁছে যাওয়া—সবই আমার ভ্রমণের গল্পে ধরা আছে। আমি ছবি তুলি, লিখি, আর খুঁজি—নতুন মানুষের মুখ, অচেনা শহরের গন্ধ, ফেলে আসা সময়ের ছায়া।

এই দীর্ঘ সফরের মধ্য থেকে কয়েকটি জায়গা হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গেছে, যেগুলো কখনো ভোলা সম্ভব নয়। নিচে আমার প্রিয় কয়েকটি ভ্রমণস্থান তুলে ধরছি, যেগুলো শুধুই প্রকৃতি নয়, বরং অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি, মানুষ আর অনুভবের এক অনন্য মিশেল।

সাজেক আমার কাছে শুধু ভ্রমণের জায়গা নয়, বরং জীবনে প্রথম সূর্যোদয় দেখা, এক পাহাড়ি দুপুরের গান, গল্প আর স্মৃতির পাতায় বাঁধা থাকা অনুভব।

সাজেক: পাহাড়ে ভেসে থাকা সাংস্কৃতিক দুপুর আর ব্যাম্বো বিরিয়ানির সন্ধ্যা
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষ, বিভাগের প্রথম ট্যুর—তাও আবার সাজেক! আমরা গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে। শীতের সকালে খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক যাওয়ার পথটা ছিল যেন ছোট ছোট স্বপ্নে বাঁধা। একদিকে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, অন্যদিকে টহল দেওয়া মেঘ—একপর্যায়ে মনে হলো আমরা মেঘের ভেতর দিয়ে চলেছি।

সাজেকে পৌঁছে মুগ্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু সবচেয়ে আনন্দ লেগেছিল আমাদের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায়। ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা যে যা কিছু পারে—গান, কবিতা, নাচ, গল্প বলা—সব মিলিয়ে একটা দারুণ সন্ধ্যা। পাহাড়ের বুকজুড়ে গড়িয়ে পড়ছিল সুর, আলো, হাসি আর স্মৃতি।

আর সাজেকের খাবার? এখনো ভুলতে পারি না সেই ব্যাম্বো বিরিয়ানির গন্ধ, হাঁসের মাংসের চমৎকার স্বাদ। খাওয়ার সময় কেউই চুপ করে বসে ছিলাম না— প্রকৃতি, বন্ধু আর খাবার মিলিয়ে মুহূর্তগুলো হয়ে উঠেছিল জাদুকরি।

সাজেক আমার কাছে শুধু ভ্রমণের জায়গা নয়, বরং জীবনে প্রথম সূর্যোদয় দেখা, এক পাহাড়ি দুপুরের গান, গল্প আর স্মৃতির পাতায় বাঁধা থাকা প্রথম বর্ষের অনুভব।

চা-বাগানের নীরবতা।

মাধবপুর লেক: চা-বাগানের নীরবতা আর পদ্মফুলে ঢাকা জল
মাধবপুর লেকের নাম শুনলেই প্রথম চোখে ভেসে ওঠে ছিমছাম চা-বাগান ঘেরা এক শান্ত জগৎ। মৌলভীবাজার জেলার বাহুবল উপজেলায় অবস্থিত এই লেক যেন প্রকৃতির খুব প্রিয় জায়গা। লেকের চারপাশে যত দূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। তার মাঝখানে ঝকঝকে জলের আয়না, যেখানে পদ্মফুল ফুটে আছে শত শত, নিঃশব্দে।

গিয়েছিলাম এক নিরিবিলি দিনে, পরিবারের সঙ্গে। চা-বাগানের পথ ধরে হেঁটে যখন লেকের পাশে পৌঁছালাম, মনে হয়েছিল যেন ছবির ফ্রেমে ঢুকে গেছি।

এই ভ্রমণের সবচেয়ে স্মরণীয় অংশ ছিল চা-বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলা। খালি পায়ে হেঁটে চলা মেয়েগুলোর চোখে ক্লান্তি, মুখে বিষণ্ণতা। একজন বলেছিল, ‘সকালে পাতা তুলতে উঠি, সন্ধ্যা হলে ঘরে ফিরি। রোজকার এই জীবনেই দিন ফুরায়।’ তখন তাকিয়ে দেখছিলাম—এই এতটা সৌন্দর্যের নিচে চাপা পড়ে আছে কত না কষ্ট।

মাধবপুর লেক যেন আমার কাছে এক দ্বিমুখী প্রতিচ্ছবি—একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে শ্রম ও জীবনসংগ্রামের মৌনতা।

নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে।

সুসং দুর্গাপুর: ধানের গন্ধে মাখা মেঘালয়-পারাবার
২০২৩ সালের নভেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রদের সঙ্গে গিয়েছিলাম নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে। চারদিকে পাকা ধানের সুবাসে ভরা, সবুজ-হলুদের সমারোহে গড়া গ্রাম। এমন মন ছুঁয়ে যাওয়া গ্রামীণ সৌন্দর্য আগে খুব একটা দেখা হয়নি।

প্রথমেই চোখে পড়ে নদীগুলো—সোমেশ্বরী, কংস। স্বচ্ছ জল, পাথর পেরিয়ে টলমল করতে থাকা ঢেউ, আর দুপাশে বসে থাকা শিশুরা। নদীর ওপারে দেখা যায় মেঘালয়ের পাহাড়—সবুজ আবরণে মোড়া, যেন দূরের এক গল্পকথা। সেদিনের রোদটা ছিল মোলায়েম, বাতাসে ধানের গন্ধ। অবশ‍্য রাস্তার অবস্থা ভালো ছিল না।

চিনামাটির সাদা পাহাড় দেখতে গিয়ে মনে হয়েছিল কোনো উপন্যাসের পাতা ওল্টাচ্ছি। মাটি নয়, যেন তুলার গম্বুজের ভেতর দাঁড়িয়ে আছি। অনেকেই ছবি তুলছিল, কেউ কেউ পাহাড়ের গা বেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম—ভাবছিলাম, এত সৌন্দর্য এতটা নিঃশব্দে থাকে কী করে!

সুসং দুর্গাপুর শুধু জায়গা নয়, আমার কাছে এটি এক নিঃশব্দ গ্রামীণ কবিতা—যেখানে ধানের গন্ধ, নদীর জল আর পাহাড়ের নীলাভতা মিলেমিশে তৈরি করে এক অন্তর্লীন অভিজ্ঞতা।

পাহাড়ি পথ, হালকা উঁচুনিচু রাস্তা, গাছের ছায়া আর দূরের পাখির ডাক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: পাহাড়ের বুকে ঘুমন্ত ক‍্যাম্পাস
প্রথমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম ২০২৩ সালের মে মাসে। গ্রীষ্মের ছুটিতে। কিন্তু ক্যাম্পাস যেন পূর্ণ জীবন নিয়ে জেগে ছিল। চারপাশে জারুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু আর নাম না জানা আরও অনেক ফুলে ভরে উঠেছিল পথঘাট, গাছের ছায়া, পাহাড়ি ঢাল। যেন কেউ রংতুলি দিয়ে পাহাড়ের বুকে এঁকে দিয়েছে এক ঘুমন্ত ক্যাম্পাস—যা সত্যিই দেখতে মুভির মতো।

ইকরা আপুর মুখে ছোটবেলায় শুনেছিলাম চবির হল লাইফের গল্প, পাহাড়ের ভেতর চলা রুটিনের জীবন, শাটল ট্রেনের কথা—তখন থেকেই একটা কৌতূহল ছিল এই ক্যাম্পাসটি নিজ চোখে দেখার।

ক্যাম্পাসটিতে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা কাটাপাহাড় রোড। সন্ধ্যার সময় সোডিয়াম লাইট জ্বলে উঠলে পথটা সোনালি আলোর মতো ঝলমল করতে থাকে। আমরা বসে থাকতাম রাস্তার ধারে, গল্প করতাম, কেউ কেউ হাঁটত ধীরে ধীরে। এই রাস্তাটার কথা মনে হলে শুধু একটাই গান মনে পড়ে—‘সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা রঙ ছিল ফাল্গুনি হাওয়াতে...’।

আরেকটা মজার অভিজ্ঞতা ছিল সাইকেল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানো। পাহাড়ি পথ, হালকা উঁচুনিচু রাস্তা, গাছের ছায়া আর দূরের পাখির ডাক—সব মিলিয়ে একটা মুগ্ধকর অনুভূতি। সাইকেল চালিয়ে একেকটা জায়গা আবিষ্কার করতাম, আর মনে হতো যেন নতুন এক চবি (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) খুঁজে নিচ্ছি নিজের মতো করে।

এবার বর্ষায় যখন আবার গিয়েছিলাম, তখন ক্যাম্পাসকে দেখলাম একেবারে অন্য রকম রূপে। বৃষ্টিধোয়া গাছ, স্যাঁতসেঁতে মাটি, কুয়াশা মেশানো বাতাস—সবকিছু যেন আরও রহস্যময় আর মায়াবী। পাহাড়ের গায়ে ধোঁয়া উঠছিল, টিলার পাশ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল, আমি হাঁটছিলাম ভেজা পথ ধরে আর ভাবছিলাম, এমন ক্যাম্পাস কি আর কোথাও আছে?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে শুধুই উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয়। এটা একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ, স্মৃতি, বন্ধুত্ব, নিঃসঙ্গতা আর আবিষ্কারের গল্প। এ ক্যাম্পাস যেন পাহাড়ের কোলে ধরা এক গল্পের বই, যেখানে প্রতিটা পৃষ্ঠা খুললেই পাওয়া যায় নতুন কোনো অভিজ্ঞতা।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়