আমাদের যে পাঠ শিখিয়ে গেলেন মাহরীন চৌধুরী
স্কুল ছুটি। ছোট ছোট শিক্ষার্থীর মনে ততক্ষণে বাসায় যাওয়ার চঞ্চল উত্তেজনা। কোনো কোনো ক্লাসের বাচ্চারা বেরিয়েও গেছে। ঠিক তখনই একটি যুদ্ধবিমান দানব পাখা মেলে আছড়ে পড়ল মাথার ওপর। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। চারদিকে ধোঁয়া আর বাচ্চাদের আর্তনাদ। সেই কঠিন মুহূর্তে বাচ্চাদের ওপর তার ডানা মেলে রয়ে গিয়েছিলেন একজন মা। তাঁর মনে প্রশ্ন, সন্তানদের রেখে কীভাবে বের হবেন?
২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী পারেননি একা বেরিয়ে আসতে। সেই কঠিন সময়েও ক্লাসরুমে থাকা যতজন শিক্ষার্থীকে পারা যায়, বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি মানবিকতার শেষ পাঠটা দিয়ে গেছেন আমাদের।
১৯৫১ সালে এমন একটা পাঠ শিখিয়ে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৮৩-এর ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট মেরি ফ্রান্সেস হাউজলি। বিমানটি বিধ্বস্ত হলে জ্বলন্ত বিমানের ভেতর থেকে ১০ জনের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তিনি। পরে তাঁকে পাওয়া গিয়েছিল চার মাসের শিশু ব্রেন্ডা জয়েস স্মিথের শরীর আঁকড়ে ধরে পোড়া অবস্থায়। এভাবেই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ‘হিরো অব দ্য ন্যাশনাল এয়ারলাইনস ফ্লাইট’ উপাধিতে সম্মান জানানো হয়েছিল তাঁকে।
‘ওরাও তো আমার সন্তান, ওদের রেখে আমি কী করে চলে আসি’ মৃত্যুর আগে নিজের স্বামীকে এ কথা বলেছিলেন আমাদের সুপারওম্যান মাহরীন চৌধুরী। কতটা উদারপ্রাণ মানুষ হলে এমন কথা কেউ বলতে পারেন, ভেবে দেখেছেন। যেখানে সুযোগ আছে নিজেকে নিরাপদে বাঁচিয়ে ফেলার।
জানুয়ারি ১৩, ১৯৮২ সালের একটি ঘটনা। এয়ার ফ্লোরিডার ফ্লাইট ৯০ বিমানটি ওয়াশিংটন ডিসির পটোম্যাক নদীতে আছড়ে পড়ে। ৭৮ জনের মৃত্যু হয় সেখানেই, বেঁচে থাকা শেষ ছয়জনের মধ্যে একজন ছিলেন আর্ল্যান্ড উইলিয়ামস। যিনি অন্য একজনের জীবন বাঁচাতে নিজের লাইফ জ্যাকেট দিয়ে দিয়েছিলেন। ডুবে মরেছিলেন সেখানেই। দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন কঠিন মানবিকতার। নিঃস্বার্থ ত্যাগের জন্য ফোরটিন্থ স্ট্রিট সেতুটি উইলিয়ামসের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে আরল্যান্ড ডি উইলিয়ামস জুনিয়র মেমোরিয়াল ব্রিজ নামে নামকরণ করা হয়।
নিজের শরীরের ৮০ শতাংশের বেশি পুড়ে যায় বাচ্চাদের বাঁচাতে আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকা মাহরীন চৌধুরীর। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মারা যান মাহরীন চৌধুরী। তিনি রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করতেন। আমাদের সুপারওম্যান। তাঁকে আমাদের মনে রাখতে হবে। জীবনের যে পাঠ শিখিয়ে গেছেন সে পাঠ কখনো ভোলার নয়। না আমাদের বাচ্চারা ভুলতে পারবে, না আমরা।