আমরা কি প্রস্তুত ছিলাম এমন সকালের জন্য

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। এ সময় হতাহতদের স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েনছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

ভোর হলো। পাখির আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই, চোখের সামনে ভেসে উঠল একেকটি মুখ। পরিচিত নয়; কিন্তু হৃদয়ের গভীরে যেন চিরচেনা। ওরা ছিল শিশু—স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কেউ হয়তো মায়ের আঁচল ধরে কাঁদছিল, কেউ বাবাকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘আজ স্কুলে না গেলে হয় না বাবা?’

মন বারবার প্রশ্ন করে—সকালে তাদের মাথায় কী চিন্তা ঘুরছিল? তারা কি বুঝতে পেরেছিল, এই সকাল হবে অন্য রকম? কারও কি একটু মন খারাপ ছিল? কেউ কি বলেছিল, ‘মা, আমার ভালো লাগছে না?’

আমার মন হুহু করে উঠে। কারও টিফিনে নিশ্চয়ই ছিল প্রিয় কোনো খাবার। হয়তো মা ভালোবাসা দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন ব্যাগ, মাথায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন শেষ চুমুটা—জানতেন না, সেই চুমুই হয়তো শেষ বিদায়।

আমরা যাঁরা মা-বাবা, যাঁরা শিক্ষক, যাঁরা কেবল একজন সাধারণ মানুষ—আমরা কি প্রস্তুত ছিলাম এমন এক ভোরের জন্য, যেখানে আগুন গিলে নেয় শিশুর স্বপ্ন, আর ধোঁয়ার ঘন কুয়াশায় হারিয়ে যায় শত শত ভবিষ্যৎ?

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছে, তছনছ করে দিয়েছে ভেতরের স্থিরতা। ছোট ছোট শিশু দগ্ধ শরীর নিয়ে দৌড়াচ্ছে, সাহায্য চাইছে, কাঁদছে—এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়। পৃথিবীর কোনো মা-বাবা, কোনো শিক্ষক এমন সকাল দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না।

শুধু চোখে জল এনে দেওয়া নয়, এ ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়—আমরা কতটা অরক্ষিত, কতটা অপ্রস্তুত, আর কতটা অবহেলায় গড়ে তুলেছি আমাদের আশ্রয়স্থলগুলোর সুরক্ষা। স্কুল, যেখানে শিশুরা সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা; সেই স্থান কীভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় ছোট্ট প্রাণগুলোকে?

স্কুলভবনে বিধ্বস্ত হয় প্রশিক্ষণ বিমান। উদ্ধার কার্যক্রমে বিভিন্ন বাহিনীর তৎপরতা।
ছবি: সাজিদ হোসাইন

আমাদের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। আবারও এক ‘কেন’ আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে—
কেন এমন হলো?
কেন নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না?
কেন আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল?
কেন বাচ্চাগুলোকে কেউ আগে বের করতে পারল না?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা সবাই চাই; কিন্তু শুধু উত্তর চেয়ে থেমে থাকলে হবে না। এখন সময় জবাবদিহি চাওয়ার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার, সিস্টেমিক পরিবর্তন আনার। প্রতিটি শিশুর জীবন অমূল্য, কোনো অব্যবস্থাপনার কারণে আমরা আর একজন শিশুকেও হারাতে চাই না।

আজ আমরা আহত শিশুদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করছি, আল্লাহ যেন তাদের দ্রুত আরোগ্য দান করেন। আর যারা চিরদিনের মতো চলে গেল, আল্লাহ যেন তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।

শোকের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। প্রতিজ্ঞা করতে চাই, এই কান্না যেন শেষ কান্না হয়।
একজন মানুষ হিসেবে আমরা আজ বাক্‌রুদ্ধ; কিন্তু নীরব থাকতে চাই না। এই শোকের মধ্যেও যেন জন্ম হয় আমাদের সচেতনতার, দায়িত্ববোধের এবং পরিবর্তনের।

মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু জরুরি কথা
এ ধরনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শুধু ক্ষতবিক্ষত শরীর নয়, ক্ষতবিক্ষত করে দেয় মনও। বিশেষ করে শিশুদের জন্য, যারা এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় মৃত্যু, দগ্ধ শরীর, চিৎকার আর বিভ্রান্তি দেখেছে, তাদের মনে এটি স্থায়ী ট্রমা হিসেবে গেঁথে যেতে পারে।

এখন আমাদের করণীয়
শিশুদের পাশে থাকতে হবে। তারা কী অনুভব করছে, তা জানতে চেষ্টার কমতি রাখা যাবে না। তারা যেন নিজেদের ভয়, কষ্ট ও আতঙ্ক প্রকাশ করতে পারে, সেই জায়গা তৈরি করতে হবে।

অভিভাবক ও শিক্ষকেরা আগে নিজেকে স্থির করুন। নিজের অস্থিরতা সামলে তবেই সন্তানের সামনে দাঁড়াতে হবে। আতঙ্ক না ছড়িয়ে, নিরাপত্তা ও সহানুভূতির ভাষায় কথা বলতে হবে।

উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত
ছবি: মীর হোসেন

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD) নিয়ে সচেতন হোন। বাচ্চারা রাতে ঘুমাতে না পারা, বারবার ভয় পাওয়া, স্কুলে যেতে না চাওয়া, আচরণে পরিবর্তন দেখা দিলে মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিন। এটা দুর্বলতা নয়; বরং যত্নের প্রথম ধাপ।

সামাজিক সহানুভূতির সংস্কৃতি গড়ে তুলুন। শোকপ্রকাশের পাশাপাশি আক্রান্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো, তাদের মনোসামাজিক সহায়তা দেওয়া, এটাও আমাদের মানবিক দায়িত্ব।

শিশুদের শারীরিক নিরাপত্তার মতো মানসিক নিরাপত্তার কথাও সমানভাবে ভাবতে হবে। এই ক্ষত যেন শুধুই স্মৃতি না হয়; বরং হোক নতুন এক সমাজ গড়ার প্রত্যয়—যেখানে প্রত্যেকটি শিশু নিরাপদ, প্রতিটি সকাল শান্ত।

লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট ও মানসিকবিষয়ক প্রশিক্ষক, কনসালট্যান্ট, সিটি হসপিটাল লিমিটেড এবং সভাপতি ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।