হোমওয়ার্কের তাড়া নেই আর

স্কুলের ক্লাসে পাওয়া খাতা।

উচ্ছ্বসিত এক দুপুর। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা সোয়া একটা। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে কিছুক্ষণ পর ছুটি হবে বলে আনন্দে মাতোয়ারা পুরো ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা উৎকর্ণ হয়ে ক্ষণ গুনছে ঘণ্টা বাজার প্রতীক্ষায়। ক্লাসরুমে চলছে হাসি-আনন্দ, বন্ধুত্বের খুনশুটি আর খেয়াল-খুশির উচ্ছ্বাস। বাসায় ফেরার আগে একে-অপরের কাছ থেকে বুঝে নিচ্ছে আগামী দিনের হোমওয়ার্ক। ওরা সবে ক্লাস থ্রিতে পড়ে; বাংলা ভার্সনের, সেকশন ‘স্কাই’।

একদিন শ্রেণিশিক্ষক স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের সেকশনের নাম রেখেছিলেন ‘স্কাই’। রঙিন বই বুকে নিয়ে ওরা স্কুলে আসতে শুরু করেছে কেবল। চোখেমুখে অজানাকে জানার আগ্রহ, আর শৈশবের দুরন্তপনায় ছুটছে প্রতিদিন। এতটুকু জীবনেই আকাশে ওড়ার আকাঙ্ক্ষা। হোমওয়ার্ক খাতার মলাটে পাখির মতো ওড়ার চিহ্ন আঁকা আছে, যেন জ্ঞানের মুক্ত আকাশে ওড়ার প্রতীক।

আরও পড়ুন

দুপুরের স্বচ্ছ আকাশে তখন উড়ছিল একটি বিমান। অনেকেই উৎসুক চোখে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। ওরা কাগজের বিমান বানিয়ে যেভাবে খেলে, এবার যেন বাস্তবেই সেই বিমানের দেখা! খুশিতে সীমা রইল না কারও। কেউ তখন জানত না, সেটি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান, যেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভূপাতিত হতে চলেছে।

হঠাৎ এক প্রচণ্ড শব্দে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠল। সেই শব্দ যেন ছিন্ন করে দিল তাদের সব স্বপ্ন। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করল পুরো ভবন। কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুনের হলকা আছড়ে পড়ল চারদিকে। আগুনের প্রাচীর পেরিয়ে কেউ নিচে নামতে পারল না। কোমল হাতে জানালার শিক নাড়িয়েও মুক্তি মেলেনি। প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত হয়তো সেই লড়াই চলেছিল। শেষে জানালার পাশে স্তূপ হয়ে পড়ে রইল দগ্ধ দেহাবশেষ। সেগুলো এতটাই ভস্মীভূত যে চেনার উপায় রইল না। বুকপকেটে রাখা আইডি কার্ডগুলোও পুড়ে ছাই; নামগুলো ঝাপসা হয়ে মা–বাবার সামনে মৃতের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে আছে এক শিক্ষার্থীর জুতা
ছবি: মো. মামুন

চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে হোমওয়ার্কের খাতাগুলো। যেন নীরব ভাষায় বলছে, আজ আর কোনো হোমওয়ার্ক নেই। কোনো শিক্ষকের ধমক নেই, নেই তাড়াহুড়া করে ঘুমানোর প্রয়োজন। সকালে উঠে আর স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই। ব্যাগ গোছানোর প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। আজ সবকিছুরই ছুটি হয়ে গেছে।

তারা আজ সত্যিই আকাশে উড়ছে সেই স্বপ্নের পথে, শিক্ষক যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাদের একদিন পাখির মতো আকাশে উড়বে বলে।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা