হুইলচেয়ারে করে ৫৩টি দেশ ভ্রমণ
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাভেল ব্লগার কোরি লি। পাওয়ার হুইলচেয়ারে করে এখন পর্যন্ত ৭ মহাদেশের ৫৩টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। একটি অলাভজনক সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেছেন ৩৫ বছর বয়সী এই যুবক। সংস্থাটির মাধ্যমে অর্থসংকটে থাকা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের ভ্রমণ স্বপ্ন পূরণ করছেন তিনি। ভ্রমণবিষয়ক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ট্রাভেল প্লাস লেইজার তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেটির নির্বাচিত অংশ বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হলো।
বয়স যখন দুই বছর, তখন আমার স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রফি ধরা পড়ে, যা একধরনের মাসকুলার ডিসট্রফি। এর ফলে আমার পুরো শরীরেই পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, আর চার বছর বয়স থেকে হাঁটতে পারতাম না। পুরোপুরি পাওয়ার হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হতো।
পরিবারের সঙ্গে ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডে যাওয়া আমার প্রথম স্মরণীয় ভ্রমণ। তখন হুইলচেয়ার ব্যবহার শুরু করি। ভ্রমণটি খুবই আনন্দদায়ক ছিল। এখনো আমি ডিজনির ভক্ত। তাদের পার্কের অনেক রাইডেই হুইলচেয়ারে থাকা সম্ভব।
১৫ বছর বয়সে প্রথম আন্তর্জাতিক ভ্রমণে যাই—বাহামাস। নতুন খাবার খাওয়ার পাশাপাশি ভিন্ন মানুষের সংস্পর্শ ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা পাই। তখন থেকেই ভ্রমণের নেশা পেয়ে বসে।
দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকায় বেড়ে উঠেছি। তখন পরিবারের সঙ্গে প্রায়ই রোড ট্রিপে যেতাম। কিন্তু দূরে ভ্রমণ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম—সংস্কৃতি ও মানুষের জীবন বোঝার জন্য বাইরে বের হতে হয়। আমি দেখেছি, পৃথিবীর সব জায়গার মানুষ আন্তরিক, সহায়ক এবং সহমর্মিতা রয়েছে।
হুইলচেয়ারে ভ্রমণ করা সহজ নয়, এখনো চ্যালেঞ্জিং। মনে হয়, প্রতিটি ভ্রমণেই অন্তত একটি সমস্যা থাকে। শুরুর দিকে পথচলা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। হুইলচেয়ার বহনকারী ট্যাক্সি বা গণপরিবহন খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। প্রথমবার যখন নিউইয়র্ক ভ্রমণে যাই, ব্রডওয়ে শোতে যাওয়ার পথে সাবওয়েতে আটকে পড়ি চার ঘণ্টা। লিফটগুলো কাজ করছিল না। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেও হুইলচেয়ার ওজনের কারণে সাহায্য করা সম্ভব হয়নি। শেষে দূরে গিয়ে একটি লিফট পাই। রাস্তায় পৌঁছে ট্যাক্সি নিলাম। শো প্রায় মিস করে ফেলি। এর পর থেকে নিউইয়র্কে গেলে শুধু ট্যাক্সি ব্যবহার করি।
প্রথমবার ইউরোপ ভ্রমণের কথা। জার্মানির মিউনিখে হুইলচেয়ার চার্জার ব্যবহার করার সময় স্ফুলিঙ্গ ছুটে গিয়ে তা পুড়ে যায়। পরের দিন আমরা একটি রিপেয়ার শপ খুঁজে পাই। শুরুর দিকের এই সমস্যাগুলো আমাকে প্রস্তুত করেছে। এখন আমি সব সময় ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করি।
কলেজ থেকে মার্কেটিং বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে থাকি। কোথাও থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। একদিন পিটসবার্গের একটি কোম্পানি ফোন করে বলল, পরের দিন ইন্টারভিউয়ে যোগ দিতে পারলে তারা আমাকে নেবে। আটলান্টা থেকে উড়ে পিটসবার্গে যাই। হায়ারিং ম্যানেজার আমাকে দেখে বললেন, ‘চাকরিতে কাজের জন্য অনেক ভ্রমণ করতে হবে। তুমি হুইলচেয়ার ব্যবহার করো, তাই তোমাকে সিলেক্ট করছি না।’ যদিও আমি ভ্রমণ করেই সেখানে পৌঁছেছিলাম, তবু আমাকে বাতিল করা হলো।
সেই সপ্তাহে কলেজ গ্র্যাজুয়েশন ট্রিপে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। তখন লক্ষ করলাম, আমাদের মতো মানুষের জন্য ভ্রমণবিষয়ক তথ্য খুব কম। এই দুই অভিজ্ঞতার প্রভাবেই ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে Curb Free With Cory Lee ব্লগ শুরু করি।
সেই সময়ে অনেক গন্তব্যে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা যেতে পারত না। এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে নতুন কোনো ট্যুর কোম্পানি অ্যাক্সেসিবল ট্রাভেল নিয়ে কাজ করছে বা নতুন পরিবহনব্যবস্থা চালু হচ্ছে। আমি কৃতজ্ঞ, পৃথিবী এখন অ্যাক্সেসিবিলিটি বুঝতে শুরু করেছে।
ছোটবেলায় তাজমহলের ছবি দেখার পর থেকে ভারতে যেতে চেয়েছি। ২০১৮ সালের আগপর্যন্ত দেশটিতে কোনো অ্যাক্সেসিবল পরিবহন ছিল না। তখন একটি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রিপ বুক করি। ভ্রমণটি অসাধারণ ছিল। বিশেষভাবে তৈরি গাড়ি আমাদের সব অ্যাক্সেসিবল স্থানে পৌঁছে দেয়। অবশেষে তাজমহল নিজ চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মীদের লড়াইয়ের কারণে পৃথিবী আরও সহজপ্রাপ্য হয়েছে। আমার জন্ম ১৯৯০ সালে। সেই বছরেই আমেরিকানস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যাক্ট পাস হয়েছিল। আমার প্রজন্ম এখন জীবনের সব ক্ষেত্রে অধিকার পাওয়ার জন্য লড়ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পার্কে হুইলচেয়ার রাখা হচ্ছে। বিনা মূল্যে এগুলো ব্যবহার করা যায়। এর ফলে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা প্রথমবারের মতো প্রকৃতি ও ট্রেইল উপভোগ করতে পারছে। সমুদ্রসৈকতের ব্যবস্থাতেও বড় পরিবর্তন এসেছে। অনেক সৈকতে মোবিলিটি ম্যাট বসানো হয়েছে, যাতে হুইলচেয়ারে বসেই বালুতে যাওয়া যায়। এ ছাড়া বিচ হুইলচেয়ারও আছে, যাতে পানি বা দূরে বালুতে যাওয়া যায়।
ছোটবেলায় মা আমাকে হুইলচেয়ার থেকে তুলে বালুতে নামাতেন। এখন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী শিশুরাও সাধারণ মানুষের মতো সৈকতে যেতে পারছে।
বিমান ভ্রমণে ফ্লাইট বুক করা সহজ। আমি একটি এয়ারলাইনসের সঙ্গে ভ্রমণ করি। হুইলচেয়ারের মাপ ও ওজন তাদের আগেই জানিয়ে দিই এবং ফ্লাইটের আগে কল করি। হুইলচেয়ারে বসেই বিমান দরজার কাছে পৌঁছাই। তারপর বিমানকর্মীদের সাহায্যে সিটে বসি। আশা করি, ভবিষ্যতে পুরো ফ্লাইটে হুইলচেয়ারে থাকা সম্ভব হবে।
২০১৮ সালে আমি Curb Free গ্রুপ ভ্রমণ শুরু করি। যেখানে ফলোয়াররা বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে আমার সঙ্গে যোগ দিতে পারে। প্রথম গন্তব্য ছিল মরক্কো। আমরা চারজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মারাকেশের গলিতে চলছিলাম। মানুষ তাকিয়ে দেখেছিল, প্রশ্ন করেছিল। আমি মনে করি, এমন আন্তর্জাতিক ভ্রমণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়।
ভারতেও অনেক মানুষ আমার ছবি তুলেছিল। কারণ, তারা পাওয়ার হুইলচেয়ার আগে দেখেনি। আমি এতে অসন্তুষ্ট নই। আশা করি, তারা প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যাপারে আরও সহমর্মী হবে।
প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য ভ্রমণে অনেক আর্থিক বাধা রয়েছে। সেটি দূর করতে ২০২২ সালে আমি অলাভজনক সংস্থা The Curb Free Foundation শুরু করি। এটি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের ভ্রমণের জন্য আর্থিক সহায়তা করে। এই সংস্থার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত আমরা অনেককে ডিজনি ওয়ার্ল্ড, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও মরক্কো পাঠিয়েছি। কয়েক মাস আগে ৮০ বছর বয়সী একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীকে জীবনে প্রথমবার সমুদ্রসৈকতে পাঠিয়েছি।
হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী হিসেবে চাইলেই বাড়িতে থাকতে পারতাম, কিন্তু ভ্রমণ সহমর্মিতা শেখায়। আমাকে সর্বদা একজন সঙ্গীর সঙ্গে ভ্রমণ করতে হয়—ফ্লাইট, বাথরুম, বিছানায় ওঠা বা শাওয়ারের সময় সাহায্য প্রয়োজন। কিন্তু আমি ভালোবাসি নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে বের হয়ে নতুন অভিজ্ঞতা পেতে। সাধারণ মানুষের উচিত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের এই অসাধারণ জীবন দেখা। এটা সত্যিই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবে।