রঙিন সিঁড়ি আর রহস্যময় গুহা: বাতু কেভস ভ্রমণের দিনলিপি
২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে পা রাখি। আধুনিক নগরীর ঝলমলে আলো, সুউচ্চ টাওয়ার আর ব্যস্ত সড়ক দেখে মনে হচ্ছিল, এক ভিন্ন দুনিয়ায় এসে পড়েছি। তবে পুরো সফরের সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা অপেক্ষা করছিল শহরের বাইরে বিখ্যাত বাতু কেভস।
কুয়ালালামপুর শহর থেকে গাড়িতে প্রায় আধা ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাই গোম্বাক জেলার এই প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক গুহায়। বাতু কেভস গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে, চুনাপাথরের পাহাড়ের ভেতরে। ১৮৮০ সালের দিকে ভারতীয় তামিল ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি কুয়ান্দি নারায়ণ প্রথম এই গুহাগুলোকে হিন্দুদের পূজার জন্য ব্যবহারের সূচনা করেন। তিনি এখানে মুরুগান দেবতার প্রতি ভক্তি জানাতে মন্দির স্থাপন করেন।
দূর থেকে চোখে পড়ল সোনালি ঝলমলে হিন্দুদেবতা লর্ড মুরুগানের ৪২ মিটার উঁচু মূর্তি, যা ২০০৬ সালে ভারতের তামিল শিল্পীদের হাতে তৈরি করা হয়েছিল। বিশাল মূর্তিটি যেন আকাশকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভক্ত ও পর্যটকদের আহ্বান জানাচ্ছে এই অনন্য স্থানে প্রবেশের জন্য। বাতু কেভস হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। প্রতিবছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় থাইপুসাম উৎসব। উৎসবের সময় হাজার হাজার ভক্ত দেবতার জন্য বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করে, কোরবানি ও প্রার্থনা করে।
প্রবেশমুখে চোখে পড়ল রঙিন সিঁড়ি—২৭২ ধাপ। প্রতিটি ধাপ যেন আলাদা রঙে আঁকা একেকটি শিল্পকর্ম। শুরুতে চমৎকার লাগলেও উঠতে গিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অনেকেই মাঝপথে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমিও হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। প্রতিটি ধাপ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা আর কৌতূহল আরও বেড়ে যাচ্ছিল। চারপাশে লাফাচ্ছিল দুষ্টু বানরেরা, আর মাঝেমধ্যে ভক্তদের প্রার্থনার শব্দ ভেসে আসছিল।
ওপরে পৌঁছাতে গুহার ভেতর যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম। বিশাল চুনাপাথরের দেয়াল, প্রাকৃতিক গম্বুজ, ফোঁটা ফোঁটা জলকণার শব্দ—সব মিলিয়ে সৃষ্টি করেছে এক রহস্যময় আবহ। দেখলাম, হিন্দুধর্মাবলম্বীরা পূজা-অর্চনায় ব্যস্ত। ভক্তির আবেশে তাঁদের মুখাবয়ব উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে পর্যটকেরা নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, ছবি তুলছিলেন, কারও চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল ফুটে উঠছিল।
এ জায়গা শুধু পর্যটনকেন্দ্র নয়, বরং ধর্ম, সংস্কৃতি আর প্রকৃতির এক অনন্য মেলবন্ধন। রঙিন সিঁড়ি, রহস্যময় গুহা, সোনালি মূর্তি আর ভক্তদের আন্তরিকতা—সব মিলিয়ে বাতু কেভসকে এক জীবন্ত অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে।
নিচে নামার সময় পেছনে তাকিয়ে আবার সেই রঙিন সিঁড়িগুলো দেখি। সূর্যের আলোয় রং আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, মালয়েশিয়ার পেনাং বা কুয়ালালামপুর যতই সুন্দর হোক না কেন, বাতু কেভসের দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকবে।
দয়াগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, ঢাকা