চাকরির জন্য কীভাবে সিভি লিখবেন? খুঁটিনাটি জানুন
বাংলাদেশের চাকরির বাজার দিন দিন প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। প্রতিবছর হাজার হাজার তরুণ-তরুণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করলেও, কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়া অনেকের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু ডিগ্রি থাকলেই হয় না—প্রয়োজন দক্ষতা, সঠিক প্রস্তুতি এবং সবচেয়ে বড় কথা, একটি পেশাদার সিভি ও সঠিক নিয়মে আবেদন করা।
কেন সিভি এত গুরুত্বপূর্ণ
অফিসে যাওয়ার আগেই আপনার সিভি নিয়োগকর্তার হাতে পৌঁছে যায়। সিভিই আপনার প্রথম ইমপ্রেশন। শত শত প্রার্থীর মধ্যে আপনার সিভি যদি আকর্ষণীয় হয়, তবেই ইন্টারভিউ কল পাওয়ার সুযোগ পাবেন। তাই সিভি হতে হবে সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট চাকরির সঙ্গে মানানসই।
সিভি নাকি রেজ্যুমে
অনেকেই বিভ্রান্ত হন—চাকরির জন্য কি সিভি জমা দিতে হবে নাকি রেজ্যুমে? মূলত দুটির উদ্দেশ্য একই হলেও কাঠামো ভিন্ন।
• সিভি: সাধারণত ২–৪ বা তার বেশি পৃষ্ঠার হয়ে থাকে। শিক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনা, কাজের অভিজ্ঞতা সবকিছু বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়। একাডেমিক বা আন্তর্জাতিক চাকরিতে বেশি প্রয়োজন হয়।
• রেজ্যুমে: ১–২ পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। নির্দিষ্ট চাকরির সঙ্গে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও অর্জন তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে অধিকাংশ নিয়োগকর্তা যদিও ‘সিভি’ বলেন, তাঁরা আসলে রেজ্যুমে প্রত্যাশা করেন।
ফ্রেশারদের সিভির কাঠামো
যাঁরা নতুন চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন, তাঁদের সিভি ছোট ও কার্যকর হওয়া জরুরি। কাঠামো হতে পারে নিম্নরূপ:
১. হেডার: সিভির একদম প্রথম অংশ, যেটা নিয়োগকর্তার চোখে সবার আগে পড়ে। তাই এটাকে হতে হবে পরিষ্কার, প্রফেশনাল এবং তথ্যসমৃদ্ধ। হেডারে থাকবে মুঠোফোন নম্বর, ই–মেইল, ঠিকানা (শহর/এরিয়া), লিংকডইন/পোর্টপোলিও (যদি থাকে)।
২. ছবি:
—ফরমাল ছবি, ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা বা হালকা নীল (সাম্প্রতিক হতে হবে, পাসপোর্ট সাইজ)।
—পোশাক; শার্ট + ব্লেজার/কোট (পুরুষদের জন্য), ফরমাল ড্রেস/শাড়ি/ব্লেজার (নারীদের জন্য)।
—মুখের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক, হাসি হালকা হলে ভালো।
৩. ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ: ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ সিভির একটি ছোট অংশ হলেও নিয়োগকর্তার কাছে আপনার লক্ষ্য ও দিকনির্দেশনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এটি হতে হবে—সংক্ষিপ্ত (২–৩ লাইনের মধ্যে), স্পষ্ট, নির্দিষ্ট চাকরিকেন্দ্রিক, পড়াশোনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
৪. শিক্ষা: শিক্ষাগত যোগ্যতার অংশ হলো সিভির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটাকে সুন্দর ও গোছানোভাবে উপস্থাপন করলে নিয়োগকর্তার জন্য আপনার সিভি পড়া অনেক সহজ হয়। সর্বশেষ ডিগ্রি ওপরে লিখবেন। প্রতিটি ডিগ্রির ক্ষেত্রে লিখবেন (ডিগ্রি নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম, পাসের বছর, সিজিপিএ)। বক্স আকারে উপস্থাপন করলে সিভি দেখতে আরও আকর্ষণীয় হবে, তথ্যগুলো একনজরে পড়া সহজ হয়। চাকরিদাতা সহজে সিভি যাছাই করতে পারেন।
৫. ইন্টার্নশিপ/প্রজেক্ট: ইন্টার্নশিপ/প্রজেক্ট অংশও সিভির একটি শক্তিশালী অংশ, বিশেষ করে নতুন গ্র্যাজুয়েট বা ফ্রেশারদের জন্য। কী লিখবেন—
•কোথায় কাজ করেছেন (প্রতিষ্ঠানের নাম)
• সময়কাল (মাস/বছর)
•দায়িত্ব (আপনি কী কী করেছেন)
• অর্জন (আপনি কী শিখেছেন/কী অবদান রেখেছেন)
বক্স আকারে দিলে ইন্টার্নশিপ/প্রজেক্টের কাজগুলো একনজরে পড়া যায়, দায়িত্ব ও অর্জন আলাদা করে চোখে পড়ে, চাকরিদাতা সহজে বুঝতে পারেন, আপনি কী অবদান রেখেছেন।
৬. দক্ষতা: দক্ষতা অংশ হলো সিভির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটিকে সুন্দরভাবে ভাগ করে উপস্থাপন করলে নিয়োগকর্তা সহজে বুঝতে পারেন আপনি কী কী পারেন।
• হার্ড স্কিল: কম্পিউটার, সফটওয়্যার, টেকনিক্যাল স্কিল, ভাষা ইত্যাদি। উদাহরণ: এমএস অফিস, এক্সেল,পাওয়ার বিআই, ফটোশপ, অটোক্যাড, পাইথন, ইংরেজি ও বাংলা ভাষা।
• সফট স্কিল: ব্যক্তিগত/ইন্টারপার্সোনাল স্কিল। উদাহরণ— যোগাযোগ দক্ষতা, সমস্যা সমাধান, নেতৃত্ব, টিমওয়ার্ক, সময় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।
৭. অর্জন/সার্টিফিকেশন: একাডেমিক পুরস্কার, অনলাইন কোর্স, স্বেচ্ছাসেবী কাজ। অর্জন /সার্টিফিকেশন সিভির একটি অতিরিক্ত মূল্য যোগ করা অংশ। এটি দেখায় আপনি শুধু পড়াশোনা বা কাজেই সীমাবদ্ধ নন, বরং নিজের উন্নয়নে অতিরিক্ত উদ্যোগ নিয়েছেন।
• একাডেমিক পুরস্কার—বৃত্তি, প্রতিযোগিতায় জয়, ডিনস লিস্ট ইত্যাদি।
• অনলাইন কোর্স/সার্টিফিকেশন—কোর্সেরা, লিংকডইন লার্নিং, উদেমি ইত্যাদি থেকে প্রাসঙ্গিক কোর্স।
• স্বেচ্ছাসেবী কাজ—সামাজিক সংগঠন, ইভেন্ট, এনজিওতে অবদান।
৮. ব্যক্তিগত তথ্য: প্রয়োজনীয় তথ্য সীমিত রাখুন (ধর্ম, রক্তের গ্রুপ, অভিভাবকের নাম বাদ দিন)। ব্যক্তিগত তথ্য অংশে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্য থাকলেই যথেষ্ট। অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিলে সিভি ভারী হয় এবং প্রফেশনাল লুক নষ্ট হয়। কী রাখবেন—
• পূর্ণ নাম
• ঠিকানা (শহর/এরিয়া পর্যন্ত, পুরো বাসার ঠিকানা না দিলেও চলে।)
জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর সিভিতে প্রাথমিকভাবে এড়িয়ে চলা ভালো। নিয়োগকর্তার জন্য মূলত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারভিউ বা ফাইনাল সিলেকশনের সময় কোম্পানি চাইলে তখন এআইডি নম্বর দেওয়া যেতে পারে।
৯. রেফারেন্স: এই অংশ সিভির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে যখন নিয়োগকর্তা আপনার সম্পর্কে অন্য কারও কাছ থেকে ধারণা নিতে চান।
রেফারেন্স দেওয়ার সঠিক নিয়ম—
• সব সময় অনুমতি নিয়ে রেফারেন্স দিন। যাতে ফোন করলে তাঁরা প্রস্তুত থাকেন।
• উচ্চপদে আছেন, কিন্তু আপনাকে চেনেন না; এ ধরনের রেফারেন্স না দিলেই ভালো।
• এমন কাউকে দিন, যিনি আপনাকে ভালোভাবে চেনেন এবং আপনার কাজ/শিক্ষা/ব্যবহার সম্পর্কে বলতে পারবেন।
• ফ্রেশারদের জন্য রেফারেন্স: একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/সুপারভাইজার, একজন প্রফেশনাল (ইন্টার্নশিপ সুপারভাইজার, পার্টটাইম জবের ম্যানেজার, বা পেশাজীবী পরিচিত)
১০. স্বাক্ষর: সিভির একদম শেষ অংশে স্বাক্ষর যুক্ত করা যায়।
• বাংলাদেশ বা স্থানীয় চাকরির আবেদনে স্বাক্ষর দেওয়া একটি প্রফেশনাল টাচ যোগ করে।
• বিদেশে আবেদন করলে স্বাক্ষর দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তবে সংযুক্ত করলে ভালো।
সিভি লেখার সময় সাধারণ ভুলগুলো
• অতিরিক্ত লম্বা সিভি। ৩–৪ পৃষ্ঠার বেশি হলে পড়তে বিরক্তিকর লাগে। সিভি সর্বোচ্চ ১–২ পৃষ্ঠার মধ্যে রাখাই ভালো।
• অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্য, ধর্ম, রক্তের গ্রুপ, অভিভাবকের নাম, এনআইডি নম্বর, উচ্চতা, ওজন ইত্যাদি দেওয়া প্রয়োজন নেই।
• ভুল বানান ও ব্যাকরণ, ছোটখাটো ভুলও নিয়োগকর্তার কাছে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে।
• প্রফেশনাল ই–মেইল ব্যবহার না করা (যেমন [email protected] – এ ধরনের ই–মেইল প্রফেশনাল না)। বরং নামের সঙ্গে মিলে এমন ই–মেইল ব্যবহার করুন (যেমন: [email protected])।
• সবার জন্য একই সিভি ব্যবহার করা। সব চাকরির জন্য একই সিভি পাঠালে সেটি নির্দিষ্ট চাকরির সঙ্গে মিলে না। প্রতিটি চাকরির জন্য সামান্য কাস্টমাইজ করা উচিত।
• শুধু দায়িত্ব লিখে অর্জন না লেখা। শুধু লিখবেন না ‘মার্কেটিং ইন্টার্ন’ হিসেবে কাজ করেছি। বরং লিখুন কী অর্জন করেছেন বা অবদান রেখেছেন।
• ডিজাইন খুব বেশি জটিল করা। বেশি রং, টেবিল, গ্রাফিক্স ব্যবহার করলে পড়তে সমস্যা হয়। সহজ ও প্রফেশনাল লেআউট ব্যবহার করুন।
• ফেক বা ভুল তথ্য দেওয়া। ভুয়া সিজিপিএ, অভিজ্ঞতা বা কোর্স লিখলে ইন্টারভিউতেই ধরা পড়ে যাবেন।
• ছবি না দেওয়া বা খুব ক্যাজুয়াল ছবি দেওয়া। প্রফেশনাল পাসপোর্ট সাইজ ছবি ব্যবহার করুন। সেলফি বা ক্যাজুয়াল ছবি দিলে খারাপ ইমপ্রেশন হয়।
• রেফারেন্স না জানিয়ে দিয়ে দেওয়া। যাঁদের নাম রেফারেন্সে দেবেন, আগে তাঁদের জানিয়ে দিন, নাহলে হঠাৎ কল পেলে তাঁরা প্রস্তুত থাকবেন না।
চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সঠিকভাবে আবেদন করার নিয়ম:
১. জব সার্কুলার ভালোভাবে পড়ুন—
• চাকরির যোগ্যতা, দায়িত্ব, ডেডলাইন—সব খুঁটিনাটি বুঝুন।
• কোন কোন ডকুমেন্ট লাগবে লিস্ট করে নিন।
২. সিভি কাস্টমাইজ করুন—
• নির্দিষ্ট চাকরির সঙ্গে মিলিয়ে সিভি সাজান।
• যে দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা ওই চাকরির জন্য প্রাসঙ্গিক, সেগুলো হাইলাইট করুন।
৩. কভার লেটার যুক্ত করুন—
• সংক্ষিপ্ত (–১ পৃষ্ঠা), স্পষ্ট, প্রফেশনাল।
• কেন আপনি এই চাকরির জন্য উপযুক্ত—সেটি তুলে ধরুন।
• কভার লেটার সব সময় কোম্পানি/পোস্ট অনুযায়ী কাস্টমাইজ করুন।
৪. আবেদনের ধরন—
• অনলাইন:
—ই–মেইল সাবজেক্টে লিখুন: Application for [Job Title]।
—ই–মেইল বডিতে ছোট্ট কভার লেটার লিখুন।
—সিভি সবসময় পিডিএফ ফরম্যাটে পাঠান।
—চাকরির আবেদন করার সময় অবশ্যই প্রফেশনাল ই–মেইল থেকে মেইল পাঠাতে হবে। প্রফেশনাল ইমেইল দেখায় যে আপনি সিরিয়াস ও গোছানো।
• অফলাইন:
—ভালো মানের কাগজে প্রিন্ট করুন।
—আবেদনপত্র ও সিভি সুন্দরভাবে ফোল্ডারে/খামে দিন।
—খামের ওপরে লিখুন: Application for [Job Title]।
৫. সময়ের মধ্যে আবেদন করুন—
• ডেডলাইনের অন্তত ২–৩ দিন আগে আবেদন করা উত্তম।
• শেষ মুহূর্তে টেকনিক্যাল সমস্যা বা ডিলে হতে পারে।
৬. ফলো-আপ করুন (যদি প্রয়োজন হয়)—
• কিছু প্রতিষ্ঠানে ভদ্রভাবে ই–মেইল/ফোন দিয়ে ফলোআপ করা যায়।
• তবে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া যাবে না।
আবেদন করার সময় যেসব ভুল এড়িয়ে চলবেন
• অপ্রফেশনাল ই–মেইল ব্যবহার করা।
• সবার জন্য একই সিভি পাঠানো।
• বানান/ব্যাকরণ ভুল থাকা।
• অপ্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া।
• শেষ দিনে আবেদন করা।
লেখক: প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা, বিক্রয় ডটকম