কেন গুরুত্বপূর্ণ পারসোনাল ব্র্যান্ডিং? যেভাবে গড়ে তুলবেন
বর্তমান সময়ে শুধু ভালো কাজ করলেই হয় না, সেই কাজটাকে সঠিকভাবে তুলে ধরাটাও জরুরি। ঠিক এখানেই আসে পারসোনাল ব্র্যান্ডিং—অর্থাৎ আপনি কে, কী করেন এবং কেন করেন—এই প্রশ্নগুলোর স্বচ্ছ উত্তর তৈরি করা ও তা সবার সামনে তুলে ধরা।
পারসোনাল ব্র্যান্ডিং বলতে বোঝায় আপনার নিজস্ব পরিচয়, ভাবমূর্তি ও দক্ষতাগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা, যাতে আপনি আলাদা করে মনে গেঁথে থাকেন মানুষের। এটা শুধুই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে তুলে ধরা নয়, বরং নিজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া এবং নিজের উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া।
কেন গুরুত্বপূর্ণ পারসোনাল ব্র্যান্ডিং
১. নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার উপায়: আপনি কে, কী পারেন এবং কোন কাজে পারদর্শী—এগুলো স্পষ্টভাবে জানাতে পারসোনাল ব্র্যান্ডিং সাহায্য করে।
২. বিশ্বস্ততা ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি: আপনি যদি একজন সৎ ও দক্ষ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারেন, মানুষ আপনার ওপর আস্থা রাখবে। ইমেজ তৈরি হবে।
৩. পেশাদার জীবনে সুযোগ বৃদ্ধি: চাকরি বা প্রজেক্টের জন্য যখন কেউ খোঁজ করে, তখন আপনার পারসোনাল ব্র্যান্ডই প্রথম চোখে পড়ে। বিশেষ করে লিংকডইনের মতো প্ল্যাটফর্মে।
৪. সমস্যা সমাধানে পরিচিত মুখ: আপনি যদি নিজের দক্ষতা তুলে ধরেন, মানুষ বুঝবে কোন সমস্যায় আপনি সহায়তা করতে পারেন।
কীভাবে শুরু করবেন পারসোনাল ব্র্যান্ডিং
১. নিজেকে জানুন: আপনি কী করতে ভালোবাসেন? কেন করতে চান? আপনার মূল লক্ষ্য কী?
– আপনি কি গল্প বলতে পারেন?
– আপনি কি ভালো বিশ্লেষক?
– আপনি কি অন্যকে শেখাতে পছন্দ করেন?
২. আপনার ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ কে?
সবার কাছে পরিচিত হওয়ার চেয়ে যাঁরা আপনার মতো মানুষ খুঁজছেন, তাঁদের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৩. নিজের ‘ভয়েস’ তৈরি করুন: নিজের মতামত, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা—সবকিছু প্রকাশ করুন নিজের ভাষায়। অনুকরণ নয়, মৌলিকতা বজায় রাখুন।
পারসোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের ৩টি স্তম্ভ
১. দক্ষতা: যে কাজে আপনি দক্ষ, সেটাকে সামনে আনুন। উদাহরণ: আপনি যদি বই রিভিউ করেন, এমন কিছু শব্দ বা উপস্থাপন পদ্ধতি ব্যবহার করুন, যা আপনার পরিচিতি তৈরি করবে।
২. মূল্যায়ন: আপনার কাজ কীভাবে অন্যরা দেখছে বা সাড়া দিচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আপনার পাঠক, শ্রোতা বা ক্লায়েন্টদের ফিডব্যাক জানুন।
৩. বিশ্বাসযোগ্যতা: প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূরণ করুন। কখনো বিভ্রান্তিমূলক বা মিথ্যা তথ্য দেবেন না। এই সততাই আপনাকে আলাদা করবে।
সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্র্যান্ডিং
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আজ সবাই পারসোনাল ব্র্যান্ড তৈরি করতে পারছে। কিন্তু সেটা হতে হবে সচেতন, পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপূর্ণ।
– ফেসবুকে কী লিখবেন?
– ইনস্টাগ্রামে কী শেয়ার করবেন?
– লিংকডইনে প্রোফাইল কীভাবে সাজাবেন?
– ইউটিউবে কেমন কনটেন্ট বানাবেন?
চিন্তাভাবনা করে, নিজের কাজের সঙ্গে মিল রেখে কনটেন্ট তৈরি করুন। আপনি কোন বিষয়ে পারদর্শী? আপনার কী এমন গুণ আছে যা মানুষকে প্রভাবিত করে? আপনি কোন বিষয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? আপনি কোন বিষয়ের জন্য ‘ফলোয়ার’ পেতে পারেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই গড়ে তোলে আপনার ব্র্যান্ড। নিজেকে বোঝাতে হবে, অন্যের চেয়ে আপনি কেন আলাদা।
কিছু সতর্কতা
• নেগেটিভ মন্তব্য আসবেই। উপকারী মন্তব্য থাকলে গ্রহণ করুন, অনাকাঙ্ক্ষিত হলে উপেক্ষা বা ডিলিট করুন।
• অনলাইনে পারফেক্ট, বাস্তবে দুর্বল? শুধু ডিজিটাল ইমেজ নয়, বাস্তবেও দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে।
• বিতর্কিত পোস্ট নয়, চিন্তাশীল পোস্ট দিন। হুটহাট কিছু না ভেবে, পেশাদারত্ব বজায় রেখে কনটেন্ট তৈরি করুন।
• সততা ও মৌলিকতা বজায় রাখুন। অন্যের কপি না করে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করুন। মানুষ সেটা টের পায়।
ইন্ট্রোভার্টদের জন্য টিপস
আপনি যদি অন্তর্মুখী হন, তবে সরাসরি না বলেও আপনার কাজ, লেখালেখি, ভিডিও বা ব্লগের মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরতে পারেন। ব্র্যান্ডিং মানেই সব সময় লাইমলাইটে থাকা নয়, নিজের অবস্থানকে জানিয়ে দেওয়া।
কাজের জায়গায় পারসোনাল ব্র্যান্ডিং
• পড়াশোনার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী কাজ বা এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি করুন
• পোর্টফোলিও বানান
• সিভিতে ব্র্যান্ডিংয়ের প্রতিফলন থাকুক
• লিংকডইন প্রোফাইল হালনাগাদ রাখুন
• নিজস্ব ওয়েবসাইট বা ব্লগ থাকলে দারুণ হয়
মনে রাখবেন পারসোনাল ব্র্যান্ডিং মানে নিজের ঢোল নিজে পেটানো নয়। এটা মানে আপনি কে, সেটা অন্যদের জানানো—সততার সঙ্গে, নিজের কাজের মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় কথা—নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলুন, যেন আপনার অনুপস্থিতিতেও মানুষ আপনাকে মনে রাখে।
আজকের দুনিয়ায় শুধু কাজ জানলেই চলবে না, নিজের পরিচয়ও তৈরি করতে হবে। আপনি কী করেন, কেন করেন, কার জন্য করেন—এই গল্পটাই হতে পারে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই নিজের পারসোনাল ব্র্যান্ডিং শুরু করুন এখনই।
উল্লেখ্য, নিজেকে উপস্থাপনার কৌশল নিয়ে গত ২৫ জুলাই রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘দ্য পাওয়ার অব পারসোনাল ব্র্যান্ডিং: ডিফাইন, ডিজাইন, ডেলিভার’ শিরোনামে দিনব্যাপী কর্মশালা করে বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ। কর্মশালায় পারসোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন লেখক ও ইনফ্লুয়েন্সার সাদমান সাদিক, লেখক ও ব্র্যান্ড মার্কেটিং প্রফেশনাল প্রলয় হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক রাফিউদ্দিন আহমেদ, বিপণনবিশেষজ্ঞ উত্তম রায়, বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক এবং শিক্ষক ও ব্র্যান্ড মার্কেটিং প্রফেশনাল সামছুদ্দোহা সাফায়েত। ওপরের লেখাটি তাঁদের আলোচনার প্রতিলিপি।