এআই টুলস দিয়ে কীভাবে সিভি আরও আকর্ষণীয় করবেন
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে একটি সাধারণ সিভি আর যথেষ্ট নয়। একটি চাকরির জন্য নিয়োগকারীরা শত শত আবেদন পান এবং বেশির ভাগ কোম্পানি আগে অ্যাপ্লিকেন্ট ট্রেকিং সিস্টেম (এটিএস) ব্যবহার করে সিভি শর্টলিস্ট করে। এর মানে হলো সিভিতে যদি সঠিক কি–ওয়ার্ড বা চাকরির প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকে, তাহলে এটি প্রথম ধাপেই বাদ পড়তে পারে
সুখবর হলো, এখন আর চিন্তার কারণ নেই। চ্যাটজিপিটি, রেজি, কিকরিজিয়্যুম, জবস্ক্যান, জেটির মতো এআই টুলগুলো কয়েক মিনিটেই সিভিকে চাকরির প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টমাইজ করে দিতে পারে। এসব টুলের সাহায্যে সহজেই জব ডেসক্রিপশন বিশ্লেষণ, কি–ওয়ার্ড খুঁজে বের করা, বুলেট পয়েন্ট নতুনভাবে লেখা এবং সিভিকে এটিএস-বান্ধব করে তোলা সম্ভব।
এই লেখায় আমরা ধাপে ধাপে দেখব, কীভাবে এআই ব্যবহার করে আপনার সিভিকে চাকরির প্রয়োজন অনুযায়ী সাজাবেন।
কেন সিভি কাস্টমাইজ করা জরুরি?
১. এটিএস ফিল্টার পাস করা: ভুল কি–ওয়ার্ড ব্যবহার করলে সিভি সরাসরি বাদ পড়ে যাবে।
২. এমপ্লয়ার–কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: কাস্টমাইজড সিভি দেখায় যে আপনি চাকরির জন্য আলাদা করে চেষ্টা করেছেন।
৩. প্রাসঙ্গিক দক্ষতা হাইলাইট করা: সব অভিজ্ঞতা সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। যা প্রয়োজনীয় তা–ই প্রাধান্য পায় কাস্টমাইজেশনে।
৪. ইন্টারভিউ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানো: টেইলরড সিভি শর্টলিস্ট হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
প্রথম ধাপ: জব ডেসক্রিপশন বিশ্লেষণ করুন
প্রথমেই জব ডেসক্রিপশন ভালোভাবে বুঝতে হবে।
• জব ডেসক্রিপশন কপি করে চ্যাটজিপিটি বা জবস্ক্যানে পেস্ট করুন।
• লিখুন: ‘এই জব ডেসক্রিপশন থেকে শীর্ষ ১০টি স্কিল, কি–ওয়ার্ড ও দায়িত্ব বের করে দিন’।
• উদাহরণ: মার্কেটিং ম্যানেজার পদের জন্য কি–ওয়ার্ড হতে পারে— ডিজিটাল মার্কেটিং, এসইও, ক্যাম্পেইন ম্যানেজমেন্ট, বাজেট হ্যান্ডলিং, অ্যানালিটিকস ইত্যাদি।
এগুলোই হলো আপনার সিভির মূল ফোকাস।
দ্বিতীয় ধাপ: কি–ওয়ার্ড মিলিয়ে নিন
জব ডেসক্রিপশন থেকে পাওয়া কি–ওয়ার্ডগুলো আপনার সিভির সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন।
• চ্যাটজিপিটিকেকে বলুন: ‘এখানে আমার সিভি দিলাম। এটাকে এই জব ডেসক্রিপশনের সঙ্গে মিলিয়ে এটিএস স্কোর বাড়ানোর মতো এডিট সাজেস্ট করুন’।
এআই দেখিয়ে দেবে কোথায় কি–ওয়ার্ড মিস হয়েছে। যেমন: জব ডেসক্রিপশনে লেখা আছে ‘গুগল অ্যানালিটিকস’; কিন্তু আপনার সিভিতে আছে ‘ওয়েব ট্রাফিক মনিটরিং’। এআই এটাকে বদলে লিখতে পারে ‘গুগল অ্যানালাইটিকস ব্যবহার করে ক্যাম্পেইন আরওআই ২৫% বাড়িয়েছি।’
এভাবে আপনার ভাষা চাকরির সঙ্গে মিলিয়ে যাবে।
তৃতীয় ধাপ: বুলেট পয়েন্ট নতুনভাবে লিখুন
দুর্বল বুলেট পয়েন্টের বদলে অ্যাচিভমেন্ট-ভিত্তিক স্টেটমেন্ট ব্যবহার করতে হবে।
• আগে: ‘সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ম্যানেজ করতাম।’
• পরে (এআই সাজেস্ট): ‘ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে টার্গেটেড কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে ব্র্যান্ড এনগেজমেন্ট ৪০% বাড়িয়েছি।’
চ্যাটজিটপিটি বা রেজিতে এসব রিরাইট খুব দ্রুত করা যায়।
চতুর্থ ধাপ: একাধিক সংস্করণ তৈরি করুন
একটি সিভি দিয়ে সব চাকরিতে আবেদন করা উচিত নয়।
• একটি মাস্টার সিভি রাখুন, যেখানে সব অভিজ্ঞতা থাকবে।
• এরপর এআই দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ তৈরি করুন:
o মার্কেটিং সিভি—ক্যাম্পেইন ও অ্যানালিটিকসে ফোকাস।
o কনটেন্ট সিভি—রাইটিং, এসইও, ব্লগিং স্কিল হাইলাইট।
o সেলস সিভি—রাজস্ব বৃদ্ধি ও ক্লায়েন্ট অর্জন দেখান।
পঞ্চম ধাপ: ফরম্যাট অপটিমাইজ করুন
চ্যাটজিপিটি কনটেন্ট সাজাবে আর রেজি, জেটি, নভোরেজিউমির মতো টুলস আপনাকে এটিএস-বান্ধব টেমপ্লেট দেবে।
• স্ট্যান্ডার্ড হেডিং ব্যবহার করুন (অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, দক্ষতা)।
• ছবি বা গ্রাফিকস এড়িয়ে চলুন।
• সহজ ফন্ট ব্যবহার করুন (Arial, Calibri)।
• লম্বা প্যারাগ্রাফ না লিখে বুলেট ব্যবহার করুন।
ষষ্ঠ ধাপ: সারাংশ বা অবজেক্টিভ কাস্টমাইজ করুন
• প্রফেশনাল সামারি অংশ কাস্টমাইজ করলে সিভি আলাদা হয়ে ওঠে।
• উদাহরণ প্রম্পট: ‘এসইও, গুগল এডস, আরওআই ইমপ্রোভমেন্ট— এই কি–ওয়ার্ড দিয়ে একটি ডিজিটাল মার্কেটিং ম্যানেজার রোলের জন্য তিন বাক্যের সামারি লিখুন।’
• এআই ফলাফল দেবে: ‘৬+ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ডিজিটাল মার্কেটিং স্পেশালিস্ট, যিনি এসইও ও গুগল অ্যাডস ব্যবহার করে আরওআই বাড়াতে সক্ষম। মাল্টিচ্যানেল ক্যাম্পেইন অপ্টিমাইজেশনে ৩০% এনগেজমেন্ট বৃদ্ধি করেছেন। পারফরম্যান্স মেট্রিক বিশ্লেষণ করে স্ট্র্যাটেজি ব্যবসার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য করেছেন।’
সপ্তম ধাপ: ট্রান্সফারেবল স্কিল হাইলাইট করুন
• আপনার পূর্বের চাকরির অভিজ্ঞতা যদি পুরোপুরি না মেলে, এআই সেটা নতুনভাবে সাজাতে সাহায্য করবে।
• উদাহরণ: জব ডেসক্রিপশনে আছে ‘প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট’; কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতায় লেখা ‘টিম লিড’।
এআই সাজেস্ট করবে: ‘প্রকল্পের ডেডলাইন মেনে টিম পরিচালনা করেছি, যা শক্তিশালী প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট দক্ষতার প্রমাণ।’
অষ্টম ধাপ: এটিএস স্কোর পরীক্ষা করুন
জবস্ক্যান বা রেজির মতো টুলস দিয়ে সিভি স্কোর চেক করুন।
• ৭০%+ স্কোর হলে সিভি ভালোভাবে এটিএস ফিল্টার পাস করবে।
• গ্রামারলি বা হেমিংওয়ে দিয়ে পড়তে সহজ কি না যাচাই করুন।
নবম ধাপ: কাস্টমাইজড কভার লেটার যোগ করুন
• সিভির পাশাপাশি কভার লেটারও টেইলর করলে আবেদন আরও শক্তিশালী হয়।
• প্রম্পট: ‘এসকিউএল, টেবলিউ, ডাটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন— এই কি–ওয়ার্ড দিয়ে ডেটা অ্যানালিস্ট পদের জন্য একটি কভার লেটার লিখুন।’
• এআই একটি খসড়া দেবে, এরপর আপনি নিজের অভিজ্ঞতা যোগ করে সেটি ব্যক্তিগত করবেন।
কাস্টমাইজড সিভি তৈরির ৯টি ধাপ (সংক্ষেপে)
১. জব ডেসক্রিপশন বিশ্লেষণ করুন
২. কি–ওয়ার্ড মেলান
৩. বুলেট পয়েন্ট আবার লিখুন
৪. একাধিক ভার্সন তৈরি করুন
৫. ফরম্যাট অপটিমাইজ করুন
৬. সামারি বা অবজেকটিভ কাস্টমাইজ করুন
৭. ট্রান্সফারেবল স্কিল হাইলাইট করুন
৮. এটিএস স্কোর পরীক্ষা করুন
৯. কভার লেটার কাস্টমাইজ করুন
এআই ব্যবহার করার সুবিধা
১. সময় সাশ্রয়: আগে একটি সিভি কাস্টমাইজ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেত। প্রতিটি জব ডেসক্রিপশন পড়া, কি–ওয়ার্ড মেলানো, বুলেট পয়েন্ট নতুন করে লেখা— সবই ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখন চ্যাটজিপিটি বা রেজির মতো এআই টুল ব্যবহার করে কয়েক মিনিটের মধ্যে জব ডেসক্রিপশন বিশ্লেষণ করে সঠিক কি–ওয়ার্ড বের করে ফেলা যায়। এতে করে আবেদনকারী একই দিনে একাধিক চাকরির জন্য সিভি কাস্টমাইজ করতে পারেন।
২. সঠিক কি–ওয়ার্ড শনাক্তকরণ: এটিএস সফটওয়্যার সিভি স্ক্রিনিংয়ের সময় প্রধানত কি–ওয়ার্ডের ওপর নির্ভর করে। যদি সঠিক কি–ওয়ার্ড না থাকে, সিভি সরাসরি বাদ পড়ে যাবে। আর এখন এআই টুলস জব ডেসক্রিপশন থেকে প্রাসঙ্গিক কি–ওয়ার্ড তুলে এনে সিভিতে যোগ করার মতো সাজেশন দেয়। যেমন জব ডেসক্রিপশনে যদি লেখা থাকে ‘এসইও অপটিমাইজেশন’, আর আপনার সিভিতে শুধু ‘ওয়েবসাইট র্যাঙ্কিং ইমপ্রুভমেন্ট’; তবে এআই এটি পরিবর্তন করে জব ডেসক্রিপশনের ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারে।
৩. অ্যাচিভমেন্ট-কেন্দ্রিক রিরাইট: অনেকেই সিভিতে ‘দায়িত্ব’ লিখে ফেলেন, কিন্তু নিয়োগকারীরা দেখতে চান ‘অ্যাচিভমেন্ট’। বর্তমানে এআই দুর্বল বা সাধারণ লাইনকে শক্তিশালী অ্যাচিভমেন্ট-ভিত্তিক লাইনে রূপান্তর করে। উদাহরণ—
• আগে: ‘টিম ম্যানেজড ফর প্রজেক্ট ডেলিভারি’।
• পরে (এআই সাজেস্ট): ‘লিড আ ফাইভ মেম্বার ক্রস-ফাংশনাল টিম টু ডেলিভার প্রজেক্ট অ্যাহেড অব সিডিউল, ইমপ্রুভিং ক্লায়েন্ট স্যাটিসফ্যাকশন বাই ২০%।
৪. এটিএস স্কোর উন্নতি: অনেক এআই টুল যেমন জবস্ক্যান, রেজি, সিভিভিজ ইত্যাদি সিভির একটি ম্যাচিং স্কোর দেয়। এই স্কোর বলে দেয় সিভি কতটা জব ডেসক্রিপশনের সঙ্গে মিলে।
• এআই সুবিধা: এআই টুলস দিয়ে বারবার চেক করলে সিভি ৭০ থেকে ৯০% এটিএস কম্প্যাটিবল হয়ে যাবে।
• এর ফলে সিভি ফিল্টার পাস করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
৫. ব্যক্তিগত কনটেন্ট তৈরি: প্রতিটি চাকরির জন্য আলাদা করে সিভি বানানো কঠিন কাজ। কিন্তু এআই এটিকে সহজ করে দেয়। এআই একাধিক সংস্করণ বানাতে সাহায্য করে; যেমন মার্কেটিং-ফোকাসড সিভি, কনটেন্ট-ফোকাসড সিভি, সেলস-ফোকাসড সিভি। প্রতিটি সংস্করণে আলাদা হাইলাইট থাকবে, যা নিয়োগকর্তার কাছে আপনাকে ‘পারফেক্ট ফিট’ হিসেবে উপস্থাপন করবে।
৬. রিডেবিলিটি ও পেশাদার টোন: অনেক সময় সিভিতে জটিল বা ভুল বাক্য চলে আসে, যা পড়তে অসুবিধা হয়। বর্তমানে গ্রামারলি, হেমিংওয়ের মতো এআই টুলস সিভিকে সহজে পড়া যায় এমন টোনে সাজায়। একই সঙ্গে এআই পেশাদার টোন বজায় রেখে কনটেন্টকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
৭. স্কিল গ্যাপ শনাক্তকরণ: অনেক সময় প্রার্থীর দক্ষতা জব ডেসক্রিপশনের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। বর্তমানে এআই শুধু সিভি সাজেস্টই করে না, বরং আপনাকে দেখায়, কোন স্কিল আপনার নেই। উদাহরণ: জব ডেসক্রিপশনে যদি টেবলেয়ো (Tableau) বা পাওয়ার বিআই (Power BI) চাওয়া হয়, আর আপনার সিভিতে না থাকে; এআই আপনাকে তা হাইলাইট করে এবং স্কিল শিখতে বলে।
যেসব ভুল এড়াতে হবে
১. অতিরিক্ত কি–ওয়ার্ড ভরাট করা: নিয়োগকর্তাদের কাছে এটি কৃত্রিম মনে হবে।
২. জেনেরিক আউটপুট ব্যবহার করা: নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সাজান।
৩. পুরোপুরি কপি করা: এআই টেমপ্লেট হুবহু ব্যবহার করবেন না।
৪. এআইর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা: চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আপনার বিচারবুদ্ধিই গুরুত্বপূর্ণ।
শেষ কথা
আজকের চাকরির বাজারে সিভি কাস্টমাইজেশন কোনো বিকল্প নয়, বরং বাধ্যতামূলক। চ্যাটজিপিটি, জবস্ক্যান, রেজি, কিকরেজিউমের মতো টুলস ব্যবহার করে সিভিকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে এটিএস-অপ্টিমাইজড, কি–ওয়ার্ড-সমৃদ্ধ এবং চাকরির জন্য প্রাসঙ্গিক করতে পারবেন। সফলতার ফর্মুলা হলো: বিশ্লেষণ—কি–ওয়ার্ড মেলানো—বুলেট রিরাইট—ফরম্যাট—টেস্ট—আবেদন। এআইর গতি আর আপনার বাস্তব অভিজ্ঞতার মিশ্রণই আপনাকে আলাদা করবে এবং আরও বেশি ইন্টারভিউর সুযোগ এনে দেবে
লেখক: প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা, বিক্রয় ডটকম