একজন একাডেমিক হিসেবে প্রায়ই উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেকে জানতে চান। বিদেশে উচ্চশিক্ষায় সম্ভাবনা ও সুযোগ, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা, কর্মজীবনসহ আরও অনেক প্রশ্ন করে থাকেন। অতীতে অভিভাবকেরা বিদেশ–জীবনের অনিশ্চয়তা ও সন্তান দূরে চলে যাবে, এ আশঙ্কা থেকে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষায় নিরুৎসাহিত করতেন। এখন সময় পাল্টেছে। অভিভাবকেরা সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে উৎসাহিত করছেন।
এই লেখায় বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
সংকল্পকরণ
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দৃঢ় সংকল্পকরণ। একবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরের কাজগুলো সহজ হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষার (মাস্টার্স, এমবিএ ও পিএইচডি) জন্য প্রস্তুতিপর্ব স্নাতকের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষেই শুরু করা উচিত। যত আগে থেকে সংকল্প করা যায়, ততই ভালো।
বিদেশের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
• একাডেমিক রেজাল্ট
• টেস্ট স্কোর (জিম্যাট/জিআরই)
• আবেদনের জন্য প্রবন্ধ বা গবেষণা প্রস্তাবনা
• স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি)
• পারসোনাল স্টেটমেন্ট (পিএস)
• ভাষাগত দক্ষতার টেস্ট আইইএলটিএস বা টোয়েফল
এ ছাড়া একাডেমিক সাফল্য, বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন, এক্সট্রাকারিকুলার কার্যক্রম, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, কোনো কোর্স বা ব্যক্তিজীবনে প্রতিকূলতার গল্প, যা তিনি সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন এবং যা তাঁকে উচ্চশিক্ষার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। পাশাপাশি নেতৃত্বের গুণাবলি, যোগাযোগের দক্ষতা ও একাডেমিক রেফারেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এসওপিতে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন তিনি এই প্রোগ্রামে উৎসাহী, প্রোগ্রাম কীভাবে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মজীবন বা উচ্চতর গবেষণায় কাজে লাগবে, কীভাবে তিনি প্রোগ্রামের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন ও কীভাবে প্রোগ্রামে অবদান রাখতে পারেন।
টেস্ট স্কোর
সাধারণত ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষার্থীদের জিম্যাট (GMAT) এবং বিজ্ঞান, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য জিআরই (GRE) স্কোর প্রযোজ্য। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই জিম্যাট বা জিআরই স্কোর গ্রহণ করে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। শিক্ষার্থীকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিতে হবে যে তারা কোনটি গ্রহণ করে। জিম্যাট বা জিআরই স্কোরের জন্য সাধারণত তিন থেকে ছয় মাস প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। আবেদনকারীর আগের ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা গণিতে ভালো বলে তাঁদের এ বিষয়ে বেশি প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষা, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের গণিতের ওপর বেশি নজর দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, ব্যবসায়, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনে প্রচুর রিডিং পড়তে হয় বলে ভার্বাল সেকশনে ভালো করেন, যা নিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে জিম্যাট বা জিআরই স্কোর ছাড়া ভর্তি হওয়া যায় বা অনেক সময় শিথিল করে। মনে রাখতে হবে, টেস্ট স্কোর ছাড়া টিউশন ফি কমানো ও স্কলারশিপের সুযোগ খুবই সীমিত। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে টিউশন ফি কমানো, মেরিট স্কলারশিপ, গ্র্যাজুয়েট সহকারী বা গবেষণা সহকারী পদ পেতে হলে অবশ্যই টেস্ট স্কোর থাকতে হবে।
ভাষাগত দক্ষতা প্রমাণের জন্য আইইএলটিএস বা টোয়েফল, যেকোনো একটি অবশ্যই লাগবে। আইইএলটিএস বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করে থাকে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। টোয়েফল প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পাশাপাশি আইইএলটিএসও গ্রহণ করে থাকে।
সম্ভাব্য গন্তব্য নির্ধারণ
স্নাতকের ফলাফল ও টেস্ট স্কোর হাতে পাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের কাজ হচ্ছে সম্ভাব্য গন্তব্য নির্ধারণ করা। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন র্যাঙ্কিং, দেশ নির্বাচনের সময় উচ্চশিক্ষার সুযোগ–সুবিধা, বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রোগ্রামের সুনাম, সেখানকার আবহাওয়া, পড়াশোনা–পরবর্তী কাজের সুযোগ ও স্থায়ীভাবে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে অভিবাসীদের প্রতি আচরণ ও ভিসা পলিসি মূল্যায়ন করতে হবে। উচ্চশিক্ষায় অন্যতম গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ইউরোপের দেশগুলো। পাশাপাশি জাপান ও চীন এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। জাপান ও চীনের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভাষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপ্রক্রিয়া একটু ভিন্ন হয়ে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রোগ্রাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং (যেমন টাইমস হায়ার এডুকেশন ও কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং) বিবেচনায় নেওয়া যায়। সব কটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ৫ থেকে ১০টি প্রোগ্রামের সংক্ষিপ্ত তালিকা করতে হবে। প্রতিটি প্রোগ্রামের কিছু স্বতন্ত্রতা থাকে, সেগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। র্যাঙ্কিংয়ের পাশাপাশি প্রফেসরদের সুনাম ও পরিচিতি, তাঁদের গবেষণার ধরন ও প্রভাব, বিভাগের সুযোগ–সুবিধা, পড়াশোনা–পরবর্তী চাকরির প্লেসমেন্ট ও গ্র্যাজুয়েটদের কাজের সুবিধা (গ্র্যাজুয়েট সহযোগী বা গবেষণা সহযোগী) ও স্কলারশিপের সুবিধাগুলো অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
ভর্তির প্রক্রিয়া
সংক্ষিপ্ত তালিকার ভিত্তিতে প্রোগ্রামগুলোর ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে হবে। এর জন্য নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের ওয়েবসাইট ভালোভাবে দেখতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তি ইভেন্টে অংশ নেওয়া, যেখানে সংশ্লিষ্টরা প্রোগ্রামের আদ্যোপান্ত বিশদভাবে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কোনো নির্দিষ্ট প্রশ্ন থাকলে, সেটা অধ্যাপকেরা উত্তর দিয়ে থাকেন। প্রোগ্রামে কোনো পরিচিত বা বাংলাদেশি শিক্ষার্থী থাকলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
প্রোগ্রামের প্রধানকে একটি সিভি ও সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল মেইল করে পাঠানো যেতে পারে। এতে প্রার্থী সম্পর্কে প্রফেসরের একটি প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়, যা পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ আবেদন বিবেচনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক সময় প্রফেসরের ই–মেইলের জবাব দেখে প্রার্থীর প্রতি তাঁর আগ্রহ কিছুটা অনুধাবন করা যায়। ই–মেইল পাঠানোর আগে অবশ্যই তথ্য ও প্রফেসরের নাম–পদবি ঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে।
আবেদন
এই ধাপে শিক্ষার্থীকে স্টেটমেন্ট অব পারপাস, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ও সার্টিফিকেট, টেস্ট স্কোর, ল্যাঙ্গুয়েজ প্রফিসিয়েন্সি স্কোর (আইইএলটিএস বা টোয়েফল), রেফারেন্স লেটার—সব প্রস্তুত করতে হবে। তারপর কাঙ্ক্ষিত প্রোগ্রামের অ্যাপ্লিকেশন পোর্টালে গিয়ে আবেদন করতে হয়। প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য, আগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ফলাফল, কাজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার সার্টিফিকেটসহ সব কাগজপত্র জমা দিতে হবে।
চেষ্টা করতে হবে নির্দিষ্ট সময়সীমার আগে আবেদন শেষ করতে। এতে প্রোগ্রামের প্রাথমিক বিবেচনায় থাকা যায় এবং কোনো স্কলারশিপ থাকলে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে। আবেদন জমা দেওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রোগ্রাম থেকে তাঁদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়।
পরিশেষে বলব, শিক্ষার্থীদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন প্রোগ্রাম বা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। সেটা অবশ্যই নির্ভর করে কী ধরনের অফার পান, সেটার ওপর। অনেক সময় সর্বোচ্চ টিউশন ফি ওয়েভার গ্র্যাজুয়েট সহকারী পদসহ সম্পূর্ণ স্কলারশিপ প্রদান করা হয়ে থাকে। অফার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলে অল্প সময়ের মধ্যে জানিয়ে দিতে হবে। এরপর পরবর্তী ধাপগুলো শুরু করা; বিশেষত ভিসা আবেদন ও অফিশিয়াল ট্রান্সক্রিপ্ট ও সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা। ভিসা পাওয়া মাত্রই টিকিট বুকিং করে ফেলতে হবে। প্রোগ্রাম শুরু করার আগে অবশ্যই কী কী কোর্স নিতে হবে, তা দেখে যাওয়া উচিত। কারিগরি দক্ষতা বা সফটওয়্যার শেখা ও কোর্স শুরুর কোনো পূর্বশর্ত থাকলে তা পূরণ করে যাওয়া উত্তম।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং
এমএসসি (ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য), এমবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।