চাকরি পরামর্শ
ইন্টারভিউর দিন যে কাজগুলো করবেন
আজকের প্রতিযোগিতামূলক যুগে চাকরি পাওয়া সহজ নয়। একজন প্রার্থীকে শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা দিয়েই নয়, তাঁর আত্মপ্রকাশ, যোগাযোগ দক্ষতা ও প্রস্তুতিও নির্ধারণ করে তিনি কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি পাবেন কি না। অনেক সময় দেখা যায়, যোগ্য প্রার্থীরা পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে ইন্টারভিউ বোর্ডে আত্মবিশ্বাস হারান বা সামান্য ভুলে সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। তাই ইন্টারভিউয়ের আগে, ইন্টারভিউ চলাকালে ও পরে কিছু মৌলিক বিষয় জানা থাকলে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। দ্বিতীয় পর্বে থাকছে ইন্টারভিউ চলাকালে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ।
ইন্টারভিউর দিনই নির্ধারণ হয়ে যায় আপনার ভাগ্য। তাই প্রতিটি মুহূর্তে দরকার সচেতনতা।
সময়মতো উপস্থিত হোন
সময়মতো পৌঁছানো মানে শুধু নিয়ম মেনে চলা নয়, এটি আপনার দায়বদ্ধতা, সময়ানুবর্তিতা ও পেশাদারত্বের প্রতিফলন। অনলাইনে ইন্টারভিউ হলে অন্তত ৫-১০ মিনিট আগে লগইন করুন, আর সরাসরি ইন্টারভিউ হলে অন্তত ১৫ মিনিট আগে উপস্থিত থাকুন। এতে আপনি মানসিকভাবে স্থির হতে পারবেন, পরিবেশ বুঝে নিতে সময় পাবেন এবং অপ্রয়োজনীয় চাপ কমবে।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, অনেক প্রার্থী অনলাইনে যোগ দেওয়ার পর বুঝতে পারেন—নেটওয়ার্ক বা সাউন্ড কাজ করছে না। আবার অফলাইনে ইন্টারভিউর ক্ষেত্রেও অনেকেই নির্ধারিত সময়ের পর উপস্থিত হন, যা বোর্ডের কাছে নেতিবাচক ইমপ্রেশন তৈরি করে। এসব ছোট ভুলই একজন প্রার্থীকে প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলে দিতে পারে।
তবে কোনো বিশেষ কারণে ইন্টারভিউতে দেরি হলে বা উপস্থিত থাকতে না পারলে সেটি উপেক্ষা না করে অন্তত একটি সংক্ষিপ্ত এসএমএস বা ফোনকল করে জানিয়ে দিন।
এই ছোট্ট সৌজন্যতাই আপনার দায়িত্ববোধ, সততা ও পেশাদার আচরণ তুলে ধরে। অনেক ক্ষেত্রে এমন বিনয়ী যোগাযোগের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে সিভি সরর্টিং বা পরবর্তী রিক্রুটমেন্টে আপনাকে বিবেচনা করতে পারে, যা আপনার পরবর্তী সুযোগের দরজা খুলে দিতে পারে।
বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক রাখুন
চোখে চোখ রেখে কথা বলা, হাসিমুখে থাকা এবং শরীরের ভঙ্গিমায় আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করা—এসব ছোট বিষয়ই ইন্টারভিউতে বড় ইমপ্রেশন তৈরি করে। সোজা হয়ে বসুন, হাত-পা নড়াচড়া সীমিত রাখুন এবং মনোযোগ দিয়ে ইন্টারভিউয়ারের কথা শুনুন।
যদি একের বেশি ইন্টারভিউয়ার উপস্থিত থাকেন, তবে কথা বলার সময় আপনার দৃষ্টি ও অবস্থান পরিবর্তন করে প্রত্যেকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন। এতে বোঝা যাবে আপনি আত্মবিশ্বাসী, মনোযোগী এবং সবার সঙ্গে সম্মানজনকভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম, যা একজন প্রার্থীর গুরুত্বপূর্ণ গুণ।
ভদ্রতা ও সৌজন্য বজায় রাখুন
ইন্টারভিউ রুমে প্রবেশের সময় প্রথম ইমপ্রেশন তৈরির অন্যতম সুযোগ থাকে আপনার হাতে। দরজা নক করে বিনয়ের সঙ্গে প্রবেশ করুন এবং ইন্টারভিউ বোর্ডের সবাইকে সালাম, শুভ সকাল বা শুভ অপরাহ্ণ জানিয়ে অভিবাদন জানান। এটি আপনার ভদ্রতা, সম্মানবোধ ও পেশাদার মনোভাবের প্রতিফলন ঘটায়।
ইন্টারভিউ চলাকালে সৌজন্য বজায় রাখুন। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ‘থ্যাংক ইউ ফর দ্য কুয়েশ্চেন’ বলতে পারেন। এতে বোর্ডের সদস্যরা আপনার আত্মসংযম ও ইতিবাচক মনোভাব অনুভব করবেন।
ইন্টারভিউ শেষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ‘থ্যাংক ইউ ফর ইউর টাইম’ বা ‘ইট ওয়াজ মাই প্লেজার স্পিকিং উইথ ইউ’ বললে তা একটি সুন্দর সমাপ্তি টানে। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময়ও হাসিমুখে বিদায় জানান। এই ছোট সৌজন্যগুলো ইন্টারভিউ শেষে বোর্ডের মনে আপনার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে, যা অনেক সময় আপনার পক্ষে ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রশ্ন মনোযোগ দিয়ে শুনুন
প্রশ্ন প্রথমে মনোযোগ দিয়ে শুনুন, বুঝুন, তারপর উত্তর দিন। অনেক সময় তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিতে গিয়ে মূল প্রশ্নের দিকটা মিস হয়ে যায়, যা ইন্টারভিউ বোর্ডের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই প্রশ্ন সম্পূর্ণ শোনার পর সংক্ষেপে নিজের ভাবনাটি গুছিয়ে নিয়ে উত্তর দিন।
যদি কোনো প্রশ্ন পরিষ্কারভাবে বুঝতে না পারেন, তাহলে দ্বিধা না করে বিনয়ের সঙ্গে বলুন, ‘কুড ইউ প্লিজ রিপিট দ্যাট’। এটি আপনার আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য ও সততার পরিচায়ক। মনে রাখবেন, ভুল উত্তর দেওয়ার চেয়ে ভদ্রভাবে প্রশ্ন পুনরায় শোনা অনেক বেশি পেশাদার আচরণ।
উত্তর দেওয়ার সময় নিচের বিষয়গুলো খেয়াল করুন—
• প্রশ্ন ভালোভাবে শুনুন: ইন্টারভিউয়ারের প্রশ্ন সম্পূর্ণভাবে শুনে তারপর উত্তর দিন। মাঝপথে বাধা না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনলে আপনার ভদ্রতা ও মনোযোগ দুই-ই প্রকাশ পাবে।
• ভাবনা গুছিয়ে উত্তর দিন: প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভাবুন। এতে উত্তর আরও স্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত ও প্রাসঙ্গিক হবে।
• বাস্তব উদাহরণ ব্যবহার করুন: নিজের অভিজ্ঞতা, প্রজেক্ট বা অর্জনের বাস্তব উদাহরণ দিন। এতে আপনার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বাস্তবভাবে বোঝানো যায়।
• ডেটা বা পরিসংখ্যান যোগ করুন: সম্ভব হলে সংখ্যায় অর্জন তুলে ধরুন, যেমন ‘Increased sales by 20%’ বা ‘Reduced error rate by 30%’। এতে আপনার কাজের প্রভাব স্পষ্ট হয়।
• সততা বজায় রাখুন: কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানলে ভদ্রভাবে স্বীকার করুন। যেমন ‘আই অ্যাম নট শিওর, বাট আই উড লাইক টু লার্ন অ্যাবাউট ইট।’ এটি আত্মবিশ্বাস ও শেখার আগ্রহের প্রতিফলন।
• ইতিবাচক টোন বজায় রাখুন: নেতিবাচক অভিজ্ঞতা বা পূর্ববর্তী কোম্পানি সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন। সর্বদা ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখুন।
এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে আপনার উত্তরগুলো শুধু তথ্যসমৃদ্ধই হবে না, বরং পেশাদার ও প্রভাববিস্তারীও হবে।
বোর্ডকে প্রশ্ন করুন
ইন্টারভিউ শুধু কোম্পানির পক্ষ থেকে আপনার যোগ্যতা যাচাইয়ের একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি আপনার জন্যও প্রতিষ্ঠানটি বোঝার এবং নিজের ক্যারিয়ার লক্ষ্যের সঙ্গে তা কতটা মানানসই, তা যাচাই করার একটি সুযোগ। তাই ইন্টারভিউ শেষে বা উপযুক্ত মুহূর্তে কিছু বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে বোঝা যায়, আপনি কেবল চাকরির জন্য আবেদন করেননি, বরং কোম্পানিটি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী এবং নিজের উন্নয়ন নিয়েও সচেতন।
আপনি নিচের মতো প্রশ্নগুলো করতে পারেন
• ‘কুড ইউ প্লিজ টেল মি মোর অ্যাবাউট দ্য টিম স্ট্রাকচার?’ এর মাধ্যমে জানতে পারবেন আপনি কোন টিমে কাজ করবেন, কার অধীন রিপোর্ট করবেন এবং টিমের কাজের ধরন কেমন।
• ‘হোয়াট আর দ্য কি চ্যালেঞ্জ ফর দিজ পজিশন?’ এটি বোঝায় আপনি দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত এবং আগাম চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।
• ‘হোয়াট কাইন্ড অব গ্রোথ অপরচুনিটিস ডাজ দ্য কোম্পানি অফার?’ এতে বোঝা যাবে, আপনি শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবছেন।
• ‘হাউ উড ইউ ডেসক্রাইব দ্য কোম্পানি কালচার?’ এটি আপনাকে সাহায্য করবে প্রতিষ্ঠানটির কাজের পরিবেশ, মূল্যবোধ ও সহকর্মীদের আচরণ সম্পর্কে ধারণা পেতে।
• ‘হোয়াট আর দ্য নেক্সট স্টেপস ইন দ্য ইন্টারভিউ প্রসেস?’ এ প্রশ্ন পেশাদারত্বের পরিচায়ক এবং ইন্টারভিউ শেষে ফলোআপের একটি ইতিবাচক ছাপ ফেলে।
এভাবে প্রশ্ন করলে বোর্ড বুঝবে আপনি আত্মবিশ্বাসী, প্রস্তুত এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী।
বেতনসংক্রান্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রে পেশাদারভাবে উত্তর দিন
ইন্টারভিউতে বেতন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি খুব কৌশল ও ভদ্রভাবে উপস্থাপন করা উচিত। এটি একটি সংবেদনশীল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই আগেভাগে প্রস্তুতি থাকা ভালো।
• কোম্পানির বেতনকাঠামো জানুন: যে পদের জন্য আবেদন করেছেন, সেই পজিশনের বাজারমূল্য বা কোম্পানির গড় বেতনকাঠামো সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা রাখুন। এটি জানলে আপনি বাস্তবসম্মতভাবে প্রত্যাশা প্রকাশ করতে পারবেন।
• আপনি যদি ফ্রেশার হন: ফ্রেশার হিসেবে বেতনের ক্ষেত্রে খুব বেশি দাবি না করে পেশাদারভাবে বলুন, ‘অ্যাজ আই অ্যাম ফ্রেশার, আই অ্যাম ওপেন টু দ্য কোম্পানিস স্যালারি পলিসি ফর দিজ পজিশন।’ এভাবে উত্তর দিলে বোর্ড বুঝবে, আপনি নমনীয় এবং শেখার সুযোগকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
• যদি অভিজ্ঞ প্রার্থী হন: অভিজ্ঞ প্রার্থীদের জন্য সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো নিজের বর্তমান বেতনের ওপর ভিত্তি করে ২০-২৫ শতাংশ বৃদ্ধির একটি যৌক্তিক প্রত্যাশা উল্লেখ করা।
• পেশাদার আচরণ বজায় রাখুন: বেতন নিয়ে কথা বলার সময় কখনোই ‘আই নিড মোর মানি’ বা ‘আই ক্যান নট ওয়ার্ক ফর লেস’- এর মতো সরাসরি বাক্য ব্যবহার করবেন না। বরং যুক্তিসংগতভাবে বলুন, ‘আই বিলিভ দ্য কমপেনসেশন শুড রিফ্লেক্ট দ্য রুলস রেসপনসিবিলিটিস অ্যান্ড দ্য ভ্যালু আই ক্যান ব্রিং টু দ্য টিম।’
এভাবে উত্তর দিলে আপনি একজন সচেতন, আত্মবিশ্বাসী ও পেশাদার প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপিত হবেন, যা ইন্টারভিউ বোর্ডের কাছে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
লেখক: প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা, বিক্রয় ডটকম