সিঙ্গাপুরের পরান থেকে-৩
কঠোর পরিশ্রম আর একাকিত্বের মধ্যে যখন দিন কাটছিল, এর মধ্যে একদিন ভীষণ দাঁতব্যথায় আক্রান্ত হলাম। ব্যথা দিন দিন বাড়তে থাকল।
এক শনিবার ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম হেলথসার্ভ ক্লিনিকে।
এবার হেলথসার্ভ ক্লিনিক সম্পর্কে একটু বলতে হয়।
ডা. গহ উই লিয়ং নামের একজন সিঙ্গাপুরিয়ান ডাক্তার ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এই কমিউনিটি ক্লিনিক। উদ্দেশ্য, অভিবাসীদের সঠিক স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন আইনগত বিষয়ে সেবা প্রদান।
সেদিন যখন ক্লিনিকে পৌঁছালাম, আমার কিউ নম্বর ছিল সবার শেষে, সময় কাটাতে এক কোণে বসে পিডিএফে বই পড়ছিলাম। একজন স্বেচ্ছাসেবক কিছুক্ষণ আমার দিকে লক্ষ করার পর, কথা বলতে এগিয়ে এল। নাম জিজ্ঞেস করতেই বললাম তাস (সিঙ্গাপুরে মানুষজন আমাকে এই নামেই বেশি চেনে)। চা অফার করল সে। চা খেতে খেতে কী করি, কোথা থেকে এসেছি, সমস্যা-সমাচার জানতে চাইল। সে আমার ইংরেজির বেশ ভালো প্রশংসা করল। আমি হাসতে হাসতে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু জানে কি না, জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে বলল, এই ক্লিনিকের বেশির ভাগ রোগীই বাঙালি, সেই সুবাদে সে অনেক বাঙালিকে চেনে।
বাংলাদেশ বা বাঙালিদের সম্পর্কে বিদেশিদের কাছ থেকে শুনতে আমি বরাবরই আগ্রহী, খুবই ভালো লাগে যখন তাদের মুখের ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে ‘বাঙলাদেশ’ শুনি।
আমি তাকে বাংলাদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালাম।
কিছুক্ষণ পর আরও কয়েজন স্বেচ্ছাসেবক ও ক্লিনিক ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচয় হলো।
তারা আমাকে প্রতি শনিবার ক্লিনিকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সাহায্য করার আমন্ত্রণ জানাল।
পরের শনিবার থেকে হেলথসার্ভে শুরু হলো আমার ‘স্বেচ্ছাসেবক ও বাংলা অনুবাদক’ হিসেবে কাজ।
শুরুর দিকে প্রতি ক্লিনিক ডেতে আমরা প্রায় ৫০-৬০ জন রোগীকে সেবা দিতাম, যদিও সম্প্রতি সেটা ৩৫-৪০-এ নামিয়ে আনা হয়েছে।
আমাদের ক্লিনিকে বাঙালি, তামিল, চায়নিজ, বার্মিজ, ফিলিপিনো আর থাইল্যান্ডি মানুষ সেবা নিতে আসে, তবে গড়ে ৭০-৮০ ভাগ রোগীই বাংলাদেশি।
২০১৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, হেলথসার্ভের তিন ক্লিনিক মিলে প্রায় ৮ হাজার রোগী স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছে, তার মধ্যে ৭৪ শতাংশ রোগী বাংলাদেশি শ্রমিক।
ক্লিনিকে কাজ করতে গিয়ে বাঙালিদের বিভিন্ন সমস্যা ও রোগ নিজ চোখে দেখেছি, পর্যবেক্ষণ করেছি। যেসব রোগী তাদের সমস্যার কথা ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলতে পারত না, সেখানে তাদের অনুবাদ করে সাহায্য করেছি। ওষুধের নিয়ম-কানুন যতটা সহজ করে পারা যায়, তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি। আমার দায়িত্ব এখানেই শেষ হয়নি। ক্লিনিক খোলার পর ঝাড়ু দেওয়া, ফ্লোর মোছা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ থেকে শুরু করে চেয়ার সাজানো, ডেস্ক সেটআপ, রেজিস্ট্রেশন, কিউ ম্যানেজমেন্টসহ টুকিটাকি সব ধরনের কাজ আমি করি। সিস্টেম কীভাবে কাজ করে, সেটা দেখতে দেখতে শিখেছি। আমি চেষ্টা করি যে কাজটা করছি, সেটা সম্পর্কে একদম শতভাগ জেনে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজ করার।
এখন আমি ক্লিনিকের প্রতিটা ধাপ জানি। ভালো-খারাপ দুই ধরনেরই অভিজ্ঞতা আমার ঝুড়িতে জমা হয়েছে।
একটা জায়গায় কাজ করতে গেলে সেখানের নিয়ম-নীতি মেনে চলতে আমি বাধ্য।
হয়তো সেই দিক থেকে অনেকের আশা পূরণ করতে পারিনি।
ক্লিনিক একটা সময় আমার পরিবারের মতো হয়ে উঠেছে। এক সপ্তাহ যেন অপেক্ষা করতে হতো আবার সবাইকে দেখার জন্য, সবার সঙ্গে কাজ করার জন্য।
আমাদের হেলথসার্ভে মাসের প্রতি সপ্তাহে একটি করে পৃথক টিম কাজ করে।
ক্লিনিক ম্যানেজার, ক্লিনিক ইন্টার্ন, দুজন ডাক্তার, ২-৪ জন নার্স ও ফার্মাসিস্ট, একজন ফিজিওথেরাপিস্ট, দুজন ক্লিনিক সমন্বয়ক, একজন ডেন্টিস্ট, দুজন ডেন্টাল সহযোগী ও ১৫-১৮ জনের ক্লিনিক সহযোগী স্বেচ্ছায় কাজ করেন। টোকেন বিতরণ, ভাইটাল সাইনস, রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ফ্রি খাবার ও ওষুধ বিতরণের কাজ আমরা সবাই মিলে করি।
আমি এই ভেবে শান্তি পাই, একটা ভালো কাজ করছি। দূর প্রবাসে বসেও নিজের দেশের মানুষের জন্য, নিজের সাধ্যমতো কিছু করছি।