খুব জানতে ইচ্ছা করে হাজার বা লাখো বছর আগে কেমন ছিল এই পৃথিবী। তখন কি সহজে মানুষের দেখা পাওয়া যেত? পৃথিবীর কোনো বিরান ভূমিতে যখন কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠী বসতি গড়ে তোলে, তখন সেটা হয়ে যায় জনপদ। তাই জানতে ইচ্ছা করে আমাদের এই জনপদ তখন কেমন ছিল? এর নামই-বা কী ছিল? তখনো কি বঙ্গোপসাগর ছিল? থাকলে এর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল শত শত নদীনালা ও বনবাদাড়। নানা তথ্যে দেখা যায়, আফ্রিকার গভীর অরণ্য থেকে উঠে আসা নেগ্রিটোরা এখানে প্রথম জনপদ গড়েছিল। ইতিহাস বলছে, তারাই এ অঞ্চলের পূর্বপুরুষ।
এসব রহস্য জানতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এর অনেক কিছু একেবারেই জানা যায় না। আবার যা জানা যায়, তা–ও পাথরের ওপর নানা লেখা বা চিহ্ন দেখে। আর অনেকটাই অনুমান করে। অবধারিত কিছু জানা গেছে—এমন তথ্য প্রায় নেই। সে যা–ই হোক, হাজার হাজার বা লাখো বছর আগের ঘটনা তো এমনই হবে।
‘বাংলা’ নামটি বাংলায় কীভাবে এল, সেটাও এক কৌতূহল। সঠিকভাবে তেমন কিছু জানা যায় না। জানার চেষ্টারও যেন শেষ নেই। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, সবকিছুর শুরু বঙ্গ থেকে। ‘বঙ্গ’ থেকে ‘বঙ্গাল’, ‘বাঙ্গাল’, ‘বঙ্গালাহ’, ‘বাঙলা’—এমন নানা শব্দের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একসময় এ জনপদে ‘বাংলা’ নামটি এসেছে। এই বঙ্গ নামেই এ অঞ্চলের সাগরের নাম হয়েছে বঙ্গোপসাগর।
বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি নিয়ে লোককাহিনিও আছে। কেউ মনে করেন, নুহ (আ.)-এর এক পুত্রের নাম ছিল হিন্দ। হিন্দের এক সন্তানের নাম ছিল বঙ্গ। তিনি বাংলায় বসতি গড়েছিলেন। এ জন্য তাঁর নামে এ অঞ্চলের নাম হয় বঙ্গ। বঙ্গ নামের আরেক পৌরাণিক কাহিনি আছে। সেটা আছে মহাভারতের আরণ্যকে। সেও প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। তখন পূর্বদেশে বলি নামের এক রাজা ছিলেন। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম নামে সেই রাজার পাঁচ সন্তান ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের নামে দেশ ছিল। সেই বলি রাজার সন্তান বঙ্গর এ অঞ্চলে রাজত্ব ছিল। তাই জনপদের নাম হয় বঙ্গ।
এভাবে ইতিহাসে বাংলা নামের নানা ধারণা এসেছে। অনেকে মনে করেন, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ছয় হাজার বছর আগে অস্ট্রিক ভাষার ‘বোঙ্গা’ থেকে ‘বাংলা’ শব্দটি এসেছে। আবার কারও ধারণা, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় এক হাজার বছর আগে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর ‘বং’ শব্দ থেকে ‘বঙ্গ’ শব্দটি এসেছে। বঙ্গ নামের এসব কহিনি যিশুখ্রিষ্ট জন্মেরও অনেক আগের।
তারপর শত শত বছর ধরে বঙ্গ নামের এক জনপদের কথা জানা যায়। মধ্যযুগে এসে বাংলা নামটি সামনে আসতে থাকে। সেটা ১৩৪২ সালের কথা। তখন শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। সোনারগাঁ জয় করে তিনি শাহি বংশের সূচনা করেন। তিনি ‘শাহ–ই–বাঙ্গালাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। অনেকে তাঁকে মধ্যযুগের প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টাও মনে করেন। তাঁর সময় থেকে এ জনপদের নাম বাংলা বলে পরিচিত হতে থাকে।
অন্যদিকে ১৬০০ সালে এ উপমহাদেশে আবুল ফজল নামের এক ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি সম্রাট আকবরের রাজদরবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি ‘আইন-ই-আকবরী’ বা আকবরের প্রশাসন নামে একটি বই লেখেন। এ বইয়ে তিনি লেখেন যে বাংলার আদি নাম ছিল বঙ্গ। তখন বড় বড় আল দিয়ে জলাবদ্ধতা রোধ করা হতো। তাই বঙ্গের সঙ্গে ‘আল’ যুক্ত হয়ে হলো ‘বঙ্গাল’, ‘বাঙ্গাল’, ‘বাঙালা’ ইত্যদি।
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে বাংলা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ভাষায় বাংলাকে গঙ্গারিডাই বা গঙ্গাঋদ্ধি লেখা হয়েছে।
চলবে...
লেখক, সংগঠক ও সাংবাদিক