কত মানুষের ভিড় এই জনপদে

টং ঘরের জানালায় তিন ত্রিপুরা শিশু। প্রতীকীছবি: সুপ্রিয় চাকমা

হাজার বছরের পুরোনো এই জনপদ এবং এর ইতিহাস। প্রথম কবে, কীভাবে এ ভূখণ্ডে মানুষ এসেছিল, সে এক জটিল প্রশ্ন। সঠিক উত্তর প্রায় নেই বললেই চলে। পৃথিবীর নানা মহাদেশ থেকে এখানে মানুষ এসেছে। এসব মানুষ আর্য এবং অনার্য জাতি নামে দুই ধারায় বিভক্ত। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আর্যরা বাংলায় আসে। এর আগে এ অঞ্চলে যে জাতি বাস করত, তারা হলো অনার্য। অনার্য জনগোষ্ঠীর আবার নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েড নামে চারটি শাখা রয়েছে।

মানুষ হলো এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের ইতিহাস লাখো বছরের পুরোনো হলেও আধুনিক মানুষের ইতিহাস প্রায় দুই লাখ বছর আগের। এরা আফ্রিকার জঙ্গলে গুহা এবং বড় গাছের নিচে বাস করত। এরা হলো নেগ্রিটো জনগোষ্ঠী।

এদেরই একটি দল প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে ভারতে আসে। একসময় তারা প্রাচীন বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এদের মাধ্যমেই পাথরের যুগ শুরু হয়। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম ওডিশার অরণ্যে তাদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী রয়েছে। আরও কয়েকটি দল সাগর পাড়ি দিয়ে আন্দামান-নিকোবরে যায়। সেখানে তারা নিজস্ব জাতিসত্তা টিকিয়ে রাখে।

এ অঞ্চলের মানুষের পূর্বপুরুষ হলো এই নেগ্রিটো জনগোষ্ঠী। তারাই প্রথম এই জনপদে পা রেখেছিল বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে ভীল, মুণ্ডা, হাড়ি, চণ্ডাল ও ডোম উপজাতি হলো এদের প্রজন্ম। বাংলাদেশের সুন্দরবন, ময়মনসিংহ ও যশোরে এদের দেখা যায়।

নেগ্রিটোদের পর বাংলায় আসে অস্ট্রিকেরা। এরাও প্রাচীন বাংলার একটি অনার্য জনগোষ্ঠী। অস্ট্রিকেরা নেগ্রিটোদের থেকে উন্নত ছিল। তাদের প্রভাবে নেগ্রিটোরা দুর্বল ও বিলুপ্ত হতে থাকে। দলে দলে এখান থেকে চলে যায়। যারা ছিল তারা অস্ট্রিকদের সঙ্গে মিশে নিজেদের বৈশিষ্ট্য হারায়।

আরও পড়ুন

অস্ট্রিকেরা কখন বাংলায় এসেছিল, এর সঠিক কোনো হিসাব নেই। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ছয় হাজার বছর আগে ইন্দোচীন ও আসাম হয়ে বাংলায় আসে। এদের থেকেই বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়।

প্রাচীন বাংলায় তারা গ্রাম গড়ে তোলে। কৃষিকাজের সূচনা করে। বাঙালি যে লাঙল ব্যবহার করে, সেটা নাকি অস্ট্রিকদের থেকেই এসেছিল। এদেরই ধারাবাহিক প্রজন্ম হলো বাংলাদেশের সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি উপজাতি জনগোষ্ঠী। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ে এদের প্রজন্ম রয়েছে।

অস্ট্রিকদের পরে বাংলায় যে জনগোষ্ঠীর বাস, তারা হলো দ্রাবিড়। সেও প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগের কথা। দ্রাবিড় জাতি নিয়ে নানা তথ্য রয়েছে। কেউ বলেন এরা বাংলার ভূমিপুত্র, কারও মতে এরা চীনের মরুভূমি থেকে এসেছে। আবার কেউ বলেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আফগান ও পাকিস্তান সীমান্তের খাইবার গিরিপথ দিয়ে বাংলায় আসে। যেভাবেই আসুক না কেন, কয়েক হাজার বছর বাংলায় তাদের বসতি ছিল। সভ্যতায় দ্রাবিড়েরা অস্ট্রিকদের ছাড়িয়ে যায়। অস্ট্রিকেরা বাংলায় এনেছিল গ্রামীণ সভ্যতা। দ্রাবিড়েরা এনেছিল নগর সভ্যতা।

সেটা ছিল খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২ হাজার ৬০০ শ বছর আগের কথা। তখন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের মহেঞ্জোদারো এবং পাঞ্জাবের হরপ্পা সভ্যতা ছিল পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অন্যতম। এই সভ্যতার স্থাপত্য নকশা ও নগর পরিকল্পনা ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠ সভ্যতার রূপকার ছিল দ্রাবিড় জাতি। এসব নানা কারণে অস্ট্রিকেরা দ্রাবিড় সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে মিশে যেতে বাধ্য হয়।

দক্ষিণ ভারতের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী দ্রাবিড়। এ ছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী রয়েছে।

দ্রাবিড়ের বাংলায় আসার কিছুকাল পর উত্তর-পূর্ব অঞ্চল দিয়ে বাংলায় আসে মঙ্গোলীয়রা। একসময়  অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয়রা মিলে একাকার হয়ে যায়। এদেরই ধারাবাহিক উত্তর প্রজন্ম বাংলাদেশের গারো, চাকমা, ত্রিপুরা, কোচসহ নানা উপজাতি।

চলবে…

লেখক ও গবেষক