চিঠি
বাসুন বারোতে (দশম পর্ব)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।
বাসুন,
নতুন অফিস আর নতুন জায়গায় আমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এখানে আসার পর প্রথম কয়েক দিন খুব হাহাকার লাগত, শূন্য লাগত। এখন আর তেমন লাগে না, তা–ই না বাবু? মানুষ মনে হয় সবচেয়ে দ্রুত মানিয়ে নেয়।
নতুন জায়গাটা যে আপন হয়ে উঠেছে সেটা বুঝতে পারলাম, ছুটির শনিবারে আমাদের পুরোনো শহর স্কারবোরো থেকে ঘুরে এসে। কী অবাক!
এই প্রথম পুরোনো বাড়ির কাছে গিয়েছিলাম আমরা, তা–ই না বাবু? তুই গিয়েছিলি পুরোনো স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। আমি ভেবেছিলাম ফেলে আসা পুরোনো বাড়ির কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াব; কিন্তু দাঁড়াইনি। আসলে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়নি।
জানিস বাবু, আজ লেখার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, মনের ভেতরে মাত্র কয়েক মাস আগের যে জ্বলজ্বলে স্মৃতি আছে, সেটাকে আর বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করেনি। কেন করেনি বাবু?
আমরা তাই ফিরে এসেছি নতুন শহর ব্রাম্পটনে।
মানুষকে ফেলে আসা জীবনে ফিরিয়ে নেওয়া কি খুব কঠিন?
সেই যে ছোটবেলায় রংপুরে নানিবাড়িটা ছিল সোনালি ছোটবেলা। কী ভীষণ টানে দিনগুলো এখনো! যদি এখন সুযোগ দেওয়া হয় রংপুরে গিয়ে থাকার; আমি কি পারব সেই ছোটবেলার মতো আনন্দ আর ভালোবাসায় জড়াজড়ি করে থাকতে? কেন এমন সব কথা মনে হয় বাজান? বারবার ফেলে আসা অতীত আর ভবিষ্যতে থাকি। কিছুতেই বর্তমানে দাঁড়াতে পারি না, কিছুতেই না। বিকেলে অফিস শেষ করে আসার আগে ভাবছিলাম, আজ লিখতে বসব। মাঝখানে বেশ কয়েক দিন সময় করে উঠতে পারিনি। কী কী করে যেন সপ্তাহ পার হয়ে গেল!
আজ তোকে মিরান্ডার কথা বলব। ওর পুরো নাম মিরান্ডা বাফো। মূল বাড়ি ইতালি। যদিও মিরান্ডার জন্ম এই দেশে, মানে কানাডায়। ওর মা–বাবা এসেছে ইতালি থেকে। ও আমাদের কস্টি ব্রাম্পটন লোকেশনের জব ডেভেলপার হিসেবে কাজ করছে।
সাদা মেয়ে মিরান্ডা ভীষণ অমায়িক। অহংকার বলতে কিছু নেই। ও বলে, ‘দেখো লুনা, এই নন–প্রফিট সেক্টরে কাজ করছি ১২ বছর। কস্টিতে আছি ৫ বছর। আমরা সারা দিনই এমন সব মানুষের সঙ্গে দেখা করি, যাঁরা কাজ চান। যেকোনো কাজ বা ডলার উপার্জন এসব মানুষের লক্ষ্য। আবার যেহেতু নতুনদের সঙ্গে কাজ করি, তাই আমরা সারাক্ষণই চাকরি না–থাকার/না–পাওয়ার সমস্যাটাই শুনতে পাই বা মানুষ কানাডায় কাজ পাচ্ছেন না, এমনটাই আমাদের শুনতে হয়। আসলে কি তা–ই? হ্যাঁ। জানি কাজ পাওয়া সহজ নয়; কিন্তু তুমি কি এটা মানো যে মানুষ যথেষ্ট অভুক্ত থাকে না, তাই কাজ পায় না?
অবাক হয়ে যাই, ‘কী বলছ মিরান্ডা? মানুষ অভুক্ত থাকে না মানে?’
‘হ্যাঁ লুনা, ঠিকই বলছি। অন্য সবার কথা বাদ দাও। চার-পাঁচ বছর আগে যখন তুমি-আমি কস্টিতে জয়েন করেছি, তখন কি কাজের অভাব ছিল না? নাকি বলবে যে তুমি চেষ্টা না করেই চাকরি পেয়েছ?’ মিরান্ডা এবার সরাসরি প্রশ্ন করে।
আমি অবাক হয়ে ওর কথা শুনছিলাম। আমাকে কিছু না বলতে দেখে মিরান্ডা আবার বলে, ‘দেখো, মানুষ যখন কথা বলে বা কাজের জন্য খুব খোঁজ করে, তখন সে বুঝতে পারে না যে তার চেয়ে বেশি চেষ্টা করছে এমন মানুষও বাজারে আছে। তুমি যখন অনেক অনেক বেশি অভুক্ত থাকবে, তখন তুমি যা পাবে তাই খাবে, তা–ই না?’ আমি বলি, ‘নিশ্চয়ই।’
‘তেমনই নতুন যাঁরা আসেন, তাঁরা প্রথম চার-পাঁচ মাস অনেক বেশি খুঁতখুঁতে থাকেন। তাঁরা যদিও আমাদের কাছে বলেন যে চাকরি চান, কিন্তু তুমি কি জানো, তাঁরা আমাদের অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর কাজ খোঁজেন না বা তাঁরা মনে করেন, কেন আমরা ছোট চাকরি করব? ছোট চাকরি করার জন্য তো আমরা কানাডায় আসিনি।’
ততক্ষণে আমি ফিরে গেছি ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। ভরা বরফের ভেতর কানাডায় পৌঁছাই আমি আর তুই। মিরান্ডাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম, ‘কেন এভাবে বলছ? আমিও নতুন ছিলাম। আমি ছোট চাকরি করেছি। ম্যাকডোনাল্ডের মেঝে পরিষ্কারের চাকরি দিয়ে কানাডায় জীবন শুরু করেছি।’
মিরান্ডা এবার ঠান্ডা গলায় বলে, ‘নিশ্চয়ই তোমার হাতে যথেষ্ট টাকা ছিল না বা তোমার নিজেকে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেওয়ার তাড়া ছিল, তা–ই না?’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ, তা ছিল।’
মিরান্ডা এবার আসল কথা বলে, ‘জানো লুনা, আমার মা–বাবা ভীষণ কষ্ট করে আমাদের চার ভাইবোনকে বড় করেছেন। আজ থেকে ৩০ বছর আগে তাঁরা কানাডায় নতুন ছিলেন। তাঁদেরও জীবন পানি করতে হয়েছে এই শহরে জায়গা করার জন্য। যদিও আমার স্বামী আছে, কিন্তু সংসারের বেশ কিছু খরচ আমার পকেট থেকেই বের করতে হয়, যেটা করতেই হয়। তাই আমি কাজ করি। কারণ, আমি যথেষ্ট অভুক্ত। আমাকে প্রতি মাসে বিল শোধ করতে হয়। যে মানুষ কাজ না করে খাবার পায়, সে অভুক্ত থাকে না। তাই তার কাজ পাওয়ার তাড়াও থাকে না।’
‘তুমি যে সারাক্ষণ নতুনদের বোঝাও আর বলো, “যেকোনো কাজে ঢুকে যাও।” তুমি কি জানো যে কয়জন কাজে ঢোকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়?’
আমি আর কথা বাড়াই না। কারণ, এসব কথা বলেছি অনেক অনেক বার। কিন্ত মিরান্ডাও যে এ সত্য জানে। মিরান্ডার মা–বাবা যে ওকে সব বুঝিয়ে বড় করেছেন, জেনে অবাক হয়ে যাই।
কেবল বাইরে থেকেই সাদা-কালো; প্রত্যেক মানুষকেই উপার্জন করতে জানতে হয়। প্রত্যেক মানুষের জন্যই সেটা সত্য, বাসুন। প্রয়োজন মানুষকে বাস্তবতা শেখায়, সবার জন্যই সেটা সবার মতো করে সত্য। তোকে প্রতিদিন বলি ফেলে আসা সময়ের কথা, খাড়া পথের কথা; যাতে তোর মনে এই বিশ্বাস শক্ত হয় যে তোকেও যে গড়ে নিতে হবে তোর নিজের জীবন।
আদর, বাসুন
তোর মা
২৮ মে ২০১২
ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা