বাসুন বারোতে (নবম পর্ব)

চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাসুন,

‘চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে। তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে, চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে।’
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (যেতে নাহি দিব)

সত্যিই এক শ্রান্ত দুপুর।
বাসুন, তুই এইমাত্র সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলি, অনেকটা দূরে তুই একাই চলে যাবি। সেই ব্রাম্পটন ডাউনটাউন লাইব্রেরিতে। আমার একাকী দুপুর, ছুটির দিনের দুপুর।

রবি ঠাকুরের কবিতার মতো আপন ছায়া পানে চেয়ে থাকা। বাংলা সাহিত্যে যত কথা কবিগুরু বলে গেছেন, এর পরে আর সাহিত্য করার দরকার পড়ে না। কিন্তু যুগে যুগে মানুষ তার মনের কথা বলে গেছে এবং লিখে বলাটাই সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছে। এই উন্নত দেশেও যেখানে যোগাযোগ এত সহজ, সেই দেশেও প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও প্রশিক্ষণে বলা হয়ে থাকে, ডায়েরি লেখা ব্যক্তিজীবনের অনেক বড় একটি আত্মমুক্তি।

মানুষ শেয়ার করতে চায়। মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করবে, এটা পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ সত্য। কিন্তু কোথায় শেয়ার করবে? কার কাছে? আধুনিক দুনিয়া আমাদের প্রতিমুহূর্তে যা দিচ্ছে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি কেড়ে নিচ্ছে। নিজেকে ১২ বছর পেছন ফিরে দেখলেই সেই সত্য দেখতে পাই। এ যেন জলের মতো সোজা করে আমারই জীবন আমার কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি।

কিন্তু যা যা নিয়ে নিল, তার জন্যই যে বেদনা বয়ে বেড়াব বাকি জীবন; তা কি আমি সতিই জানতাম? নাকি কেউ জানে কোনো দিন?

আরও পড়ুন

তোর বাবার সঙ্গে যখন সংসার করতাম, তখন নানা টানাপোড়েন ছিল। কেবল মনে হতো, কবে মুক্তি মিলবে? কেমন করে এই জীবন থেকে মুক্তি পাব? প্রথম দিকে যখন তুই আসিসনি, তখন একরকম করে এই উপলব্ধি হতো। তোর বাবা অফিসে চলে গেলে কোনো কোনো দুপুরে যখন বাসায় একা থাকতে হতো, তখন মনে হতো, ইশ! আমি যদি একা থাকতে পারতাম, সম্পূর্ণ একা।

স্বাধীন একটা জীবন কি কোনো দিনই একটা মেয়ে পেতে পারে না? অফিস করব, নিজের বাসা থাকবে, অফিসে যাব, নিজে উপার্জন করব, নিজের মতো থাকব। কিন্তু সে সময় বুঝতে পারতাম যে বাংলাদেশে এটা কঠিন কাজ। যদিও যখনকার কথা বলছি, তখন বিদেশে আসার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। সেটা ১৯৯৫-৯৬ সাল হবে।

এরপর তুই এলি আমাদের জীবনে। তখন আরেক উত্তাপ। কিছুদিন পরপরই তোর বাবার সঙ্গে খারাপ থাকতে শুরু করলাম। এসব কথা খুব সাবলীলভাবে বলি; কারণ জানি, যাঁরাই দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকেন, বছরের পর বছর বা যুগের পর যুগ, তাঁদের সবার জীবনই অনেক অনেক বেশি একঘেয়ে। পাছে এই একঘেয়ে জীবন বহন করা অনেক অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়, তাই মানুষ এসব ভাবতে চায় না। সংসারে বাচ্চা, কাজ, অন্য নানাবিধ ইস্যু দিয়ে জীবনকে ব্যস্ত রাখে; যাতে এসব কথা তাঁর মনে (কি ছেলে/কি মেয়ে) উঁকি না দেয়।

যাহোক, তুই আসার পর জীবন অন্যদিকে মোড় নিল। আগে তোর বাবার সঙ্গে কিছু হলে নিজেকে যেমন অসহায় মনে হতো, এখন আর তেমন মনে হলো না। এখন মনে হলো, তুই আছিস। বাঁচতে হবে মাথা উঁচু করে। তাই তুই আসার পর আমি নতুন করে বাঁচার শক্তি পেলাম যেন। জানিস বাসুন, একটা বিষয় আমি দেখলাম, এই দেশে আমেরিকা/ কানাডায় প্রতিটা শিশুকে বলা হয় ডায়মন্ড।

কারণ, শিশুদের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বড় করা হবে, আর বয়স্করা। কারণ, তাঁদের সম্মান করার মাধ্যমে একটা শক্তিশালী জাতি গড়ে উঠবে। আমি অবাক হয়ে যেতাম, বাংলাদেশে অনেকেই যখন আমাকে বলতেন এমনকি নিকট পরিবারের মানুষেরাও যখন বলেন, ‘তুমি বাচ্চা নিলে কেন? যদি জানতে যে তুমি সংসার টেকাতে পারবে না?’

আমি অবাক হতাম, আরে বাবা সংসার টেকার সঙ্গে বাচ্চার কী সম্পর্ক? এখন বুঝি। কারণ, এখনো বাংলাদেশ ৯৯ শতাংশ মেয়েকে দেখা হয় সে সংসারের ঘানি কতটা টানতে পারবে। একটি মেয়ে যত কম বয়সী, তাকে দমন করা তত সহজ। বাংলাদেশের মতো একটা দেশেই কেবল মেয়েরা যত বেশি শিক্ষিত হয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়, সেই পরিবার তত বেশি ভয় পায়। কারণ, তারা জানে যে শিক্ষিত, সচেতন, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী মেয়ের বিয়ে দেওয়া কঠিন।

অন্যদিকে, একটি ছেলে? যত তার বয়স বাড়ে, যত তার টাকা-পয়সার সক্ষমতা বাড়ে, তার পছন্দ তত বাড়তে থাকে। আর সেই একই মেয়ের পছন্দ কমতে থাকে। সেই সমাজের মানুষ আমাকে প্রশ্ন করবে, সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক।

এরপর তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। কবে নিজের মতো বাঁচতে পারব? যদি ভীষণ সত্যি করে বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে, আমি আজকের দিনগুলোর স্বপ্নই যেন দেখেছিলাম। নিজের হাতে গড়া সংসার থাকবে, তোকে বড় করে তুলব, রান্না করব, লেখালেখি করব, নিজের ছোট একটা ঘর আর পড়ার টেবিল থাকবে। নীরব দুপুরে বা বেলা পড়ে আসা সন্ধ্যায় নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলব। কষ্টের দিন পাড় করা এই ৪০ বছরের জীবন সোনা, আজ কতটা পথ পেরিয়ে তোর সঙ্গে আমি কথা বলি, সেটা যে তুই জানিস না। সেটাই সৌভাগ্য বাবু। এই চিঠি তুই পড়তে পারলে কি আর আমি এমন মন খুলে লিখতে পারতাম বাসুন?

কিছুতেই না রে সোনা। মানুষ তার গভীর দুঃখ এমন কাউকেই বলতে চায়, যে স্বার্থহীনভাবে শুনবে, কিন্তু ভুল বুঝবে না। আধুনিক দুনিয়া আমাদের হয়তো অনেক অনেক কিছু দিচ্ছে; কিন্তু পৃথিবী থেকে স্বার্থহীন সম্পর্ক খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

মানুষ আর মানুষকে সেই অর্থে ভরসা করে না বাসুন। জানিস তুই, এই ছোট চিঠি যাঁরা পড়েন, তাঁরা কেউই আমাকে সেইভাবে চেনেন না বলেই একান্ত মনের কথা বলি। কিছুটা ভারমুক্ত হই। আজ দুপুরে যখন একা ঘরের ভেতর পড়ছিলাম ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটা, তখন থেকেই মনে হচ্ছিল, আসলেই তা–ই। যেতে দিতে চাই না এই জীবনকে, কিছুতেই যেতে দিতে চাই না, কিছুতেই না। কিন্তু ওই যে কবি বলেছেন আবার—
‘ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে
এ জগতে, শুধু বলে রাখা “যেতে দিতে
ইচ্ছা নাহি।”’

আদর বাসুন
তোর মা
২০ মে ২০১২

ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা