বাসুন বারোতে (পর্ব ১৭)

চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাসুন,

বেশ ঠান্ডা পড়ে গেল। সেই কখন ঘুম ভেঙেছে, কিন্তু মোটা কম্বলের ওম থেকে বের হওয়ার আলসেমিতে এতক্ষণ বিছানায় ছিলাম। এইমাত্র পায়ে মোটা মোজা পরে টেবিলে বসলাম। তেমন সকাল হয়নি যদিও, মাত্র সকাল আটটা। ছুটির দিনে এটা কোনো সকালই না। ঘুম ভেঙেছে আরও দুই ঘণ্টা আগে, প্রতিদিনের অভ্যাসমতো।

জানিস বাবু, নিজের ভেতরে যে সত্তা বাস করে, তাকে দেখেই অবাক বনে যাই প্রতিদিন; অন্য মানুষকে চিনব কী করে এক জীবনে? নিজেকেই কি চিনি আমরা সবাই?
কথাগুলো বলছি কেন, জানিস?

এই যে রুটিন করে একটা জীবন যাপন করি; এইটুকই কি সবটা আমি? আমি কি নিজেই মানি সে কথা?

প্রতিদিনের ঘটনা জীবনকে আলোড়িত করে। এক একটি ঘটনা যখন আসে বা যখন আন্দোলিত হই, সেই মুহূর্তে মনে হয়, এই তো জীবন; যা দেখার জন্য বেঁচে আছি বা যা পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই ঘোর থাকতে থাকতেই আবার বানের জলের মতো ভেসে যাই অন্য ঘটনা দিয়ে। এই কি আমাদের সবার জীবন? নাকি এই আমার ভেতরে বাস করা অন্য এক আমি? কেন বলছি শোনো তাহলে।

গতকাল শনিবার ছুটির দিনে বের হয়েছিলাম হাঁটতে। আমাদের বাসা থেকে মাত্র ২৫ মিনিটের হাঁটা পথের ভেতরে কলেজ। যেখান থেকে দুই বছরের ডিপ্লোমা করে এই শহরে নিজের ভাগ্য ফিরে পেয়েছিলাম। তাই সেই দিনগুলোই আমার কাছে সেরা দিন।

মাত্র পাঁচ বছর আগে, কলেজে যেতাম, বেজমেন্টের বাসায় থাকতাম তোকে নিয়ে। আর স্বপ্ন দেখতাম একদিন এই শহরে মাথা উঁচু করে বাঁচব। একটা চাকরি থাকবে। সামাজিকভাবে যে চাকরি শক্তি দেবে। অনেক ডলারের বেতন দরকার নেই। কিন্তু একটা ভালো মানসম্মত জীবন। আজকে তোকে নিয়ে যে জীবনটা যাপন করছি, অনেকটাই তেমন স্বপ্ন বলতে পারিস।

আরও পড়ুন

সেই কলেজ বাবু, টরন্টো শহরের ওয়ার্ডেন/অ্যাগ্লিন্টন ইন্টারসেকশনে সেন্টেনিয়াল কলেজ, এস্টনবি ক্যাম্পাস। সেখানেই গিয়েছিলাম গতকাল সকালে। বেশ মিষ্টি রোদ ছিল। সেই সময়ে ফেলে আসা স্মৃতি পেয়ে বসল। আমি কি জানতাম গতকাল সকালে কত বড় একটা শক্তি আমাকে এভাবে ভাবিয়ে তুলবে? না বাবু, জানতাম না। আগে থেকেই যদি জানতাম সবকিছু, তাহলে জীবনে সবচেয়ে বড় আনন্দ হারিয়ে ফেলতাম আমরা সবাই। সেই আনন্দের নাম অপেক্ষা।

গতকাল কলেজের মুখে যেতেই দেখি এক বয়স্ক নারী জানতে চাইছে, কলেজ বন্ধ কি না বা কখন খুলবে। আমি জানি না বলাতে সে আবার বলে, ‘ও তাহলে তুমিও আমার মতো। কোনো কোর্স ইনফরমেশন খুঁজছ বুঝি?’ আমি তখন মহিলাকে ডেকে বলি, ‘আসো আমিই তোমার সঙ্গে কথা বলি। কী চাও আমি কি জানতে পারি?’

বাবু, তোর কি মনে আছে আমি এই কলেজে নিউ কামার স্টুডেন্ট সার্ভিসে পেইড জব করতাম, এই তো ২০০৬ সালে। তাই এই বয়স্ক মহিলার সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু তখনো বুঝিনি, জয়েস নামে ৬১ বছর বয়সী চাইনিজ মহিলা, যার জন্ম কানাডায়, সে আমাকে এত অবাক করবে।

জয়েস প্রায় ৩০ বছর কাজ করেছে ফ্যাক্টরিতে। লেবার জব যাকে বলে। তারপর ৫৭-৫৮ বছর বয়সে হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্স-এর ওপরে একটা কোর্স করে সেই সেক্টরে কাজ করছিল গত দুই বছর। এখন সেই অফিসেও ঘণ্টা কমে এসেছে। তাই জয়েস আবার কোর্স করে নিজেকে আপগ্রেড করতে চায়। কারণ, বেঁচে থাকার জন্য নাকি ওর এনাফ ডলার হাতে নেই। অবাক হয়ে ওকে বলি, ‘কেন তোমার স্বামী-সন্তান নেই? তারা তোমাকে দেখে না?’ জয়েস আরও অবাক হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, সবাই আছে। আমার ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো সেটেল। স্বামী অসুস্থ। আমিই দেখাশোনা করি। কিন্তু তুমি কেন আমাকে এই সব প্রশ্ন করছ?’

আবার বলি, ‘তুমি তো ওদের কাছ থেকে সাপোর্ট নিতে পারো। এই বয়সে আবার পড়াশোনা করবে?’ জয়েস এবার ধমকে ওঠে, ‘দেখো মেয়ে, আমি কারও সাপোর্ট নিয়ে চলি না। আমি নিজে স্বাবলম্বী থাকতে চাই। আর আমি যদি পড়াশোনা করে নিজেকে গড়তে চাই, তুমি বাধা দেবার কে হে?’ আমি আবার বলি, ‘এই দেশে তো সোশ্যাল সিস্টেম আছে। তুমি অ্যাপ্লাই করলে তো সরকারি ভাতা পাবে।’ এবার জয়েস আর দাঁড়ায় না। বলে, ‘তুমি কি আমাকে এসব বলার জন্য ডেকেছ? দেখো, আমার বয়স হতে পারে; কিন্তু আমার শক্তি ফুরায়নি, গুডবাই।’

জানিস বাবু, গতকাল সারা দিন জয়েসের কথা ভেবেছি। মানুষের শক্তি কি এত প্রবল হওয়া দরকার? কই, তাহলে আমরা বাংলাদেশ থেকে ৩৬-৩৭ বছর বয়সে কানাডায় এসেই যে হাল ছেড়ে দিই, দুই-তিন বছর কষ্ট না করতেই যে সোশ্যালে অ্যাপ্লাই করি? নিজে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নানান মিথ্যা কথা বলে সরকারি বাড়িতে থাকার জন্য যুগ যুগ পার করে দিই? তাহলে আমরা কেন স্বাবলম্বী হতে চাই না জয়েসের মতো?

আর না বাবু, অনেক হলো। পৃথিবীর সব মানুষ চলবে নিজের হিসাবে। জয়েসরা সেখানে শুধু শক্তি দেবে। কিন্তু সেই সাহসের আলো যারা দেখতে চাইবে না, তাদের চোখ খুলবে কে? গতকাল জয়েস আমাকে আবার শক্তি দিয়েছে। শুরু করার শক্তি।

এবার কালরাতের কথা বলে শেষ করি। ছুটির দিনের রাত। ছয় দিন গত হলো তুই আর আমি নিজেদের ঘরে ঘুমাই। তোর ঘরে সিঙ্গেল বেড, আমার ঘরেও তা–ই। পরিপাটি সাজানো আমার আর তোর ভুবন, কি নীরব দিনগুলো আমাদের তাই না বাবু।

এই রোববার সকালে এখনো তুই শুয়ে আছিস। আমাদের সারা বাসায় পিনপতন নীরবতা। কাল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটা সিনেমা দেখলাম, অপর্ণা সেনের ‘জাপানিজ ওয়াইফ’। সারা রাত প্রশ্ন করেছি নিজেকে। কী চেয়েছিলাম এই জীবনের কাছে? কেবল কি নিরাপদে বাঁচা? আর কিছু, আর কি কিছুই চাইনি? কামনা, বাসনা-ভালোবাসা? এই যে নিরন্তর বয়ে যাওয়া জীবনে শক্তি আসে কোথা থেকে? জয়েস বলল, অসুস্থ স্বামীকে দেখাশোনা করে। একজন অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য। তাই দায়িত্ববোধ করে জয়েস। সেই একই দায়িত্ববোধ করত অপর্ণা সেনের নায়ক স্নেহন্ময়। জাপানি বউ মিয়াগি বেঁচে ছিল দীর্ঘ জীবন শুধু ভালোবাসা পাবে এই অপেক্ষায়। একমুহূর্তের জন্য টলে যায়নি জাপানি মেয়ে মিয়াগি বা ওর পাত্র মিতালীর স্বামী স্নেহময়। এই কি জীবনের একাগ্রতা? যা ভালোবাসার চেয়ে বড়।

যখন লিখতে বসি তখন নিজের ভেতরেই নিজেকে আবার গড়ে তোলার শক্তি খুঁজি বাবু। ভালোবাসা দিয়ে লেখা প্রতিটা চিঠি আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখে, শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকব প্রতিমুহূর্তে।

তোকে আদর বাবু
মা
২৩ অক্টোবর ২০১২

স্কারবোরো, টরন্টো, কানাডা