চিঠি
বাসুন বারোতে (পর্ব ১৬)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।
বাসুন,
বিকেল সোয়া পাঁচটা, টরন্টো শহরে এখনো পুরোদস্তুর গরম চলছে। সেই সঙ্গে আজ ছিল লং উইকেন্ডের শেষ বিকেল। মানে আজ সোমবার। আগামীকাল শুরু হবে নতুন সপ্তাহ। তোর গ্রেড এইট আর আমার নতুন লোকেশনে অফিস।
আমরা ফিরে এসেছি আমাদের সেই পুরোনো শহর স্কারবোরোতে। ভাবতে অবাক লাগছে, মাঝখানে মাত্র চার মাস ছিলাম ব্রাম্পটনে। এই পুরোনো শহর বা পরিচিত জায়গায় ফিরে এসে তুই তোর বন্ধুদের ফিরে পেয়েছিস। কী ভীষণ খুশি তুই! আর আমি এসেছি আমার বাংলাদেশের মানুষদের কাছাকাছি। কারও সঙ্গে যোগাযোগ হোক বা না হোক, তবু তো জানি, আমি আছি অনেকের কাছে/ সঙ্গে। জীবনে এই অনুভূতিকেই নতুন করে বুঝে এলাম ব্রাম্পটনে গিয়ে। কী চাই আসলে জীবনে? আমরা কি সেই মানুষ, যেখানেই যাই, যা করি, সেটার পক্ষেই যুক্তি দাঁড় করিয়ে শান্ত করি নিজেকেই?
মনে আছে বাবু তোর? আমাদের সেই ব্রাম্পটনের ছোট নিরিবিলি বাড়ির কথা?
আমার অফিস আর তোর স্কুল শেষে আমাদের কিছুই করার থাকত না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সময় সময় তুই ভীষণ মন খারাপ করে বলতি, ‘মা, আমরা কি টরন্টোয় ফিরে যেতে পারি না? তুমি কি আবার টরন্টোয় জব পেতে পারো না? আমি আমার পুরোনো স্কুলে ফিরে যেতে চাই। আমার বন্ধুদের কাছে যেতে চাই, মা?’ কী বলব বল, বাবু? তোকে নিয়ে ব্রাম্পটনে ছিলাম মাত্র চার মাস। কিন্তু এখন মনে হয় অনেকটা সময়। আবার চেষ্টা শুরু করলাম। বর্তমান অফিসেই ইন্টারনাল নানা পদে আবেদন করলাম। এই তো বাবু, মাত্র এক সপ্তাহ আগে আমরা আবার ফিরে এসেছি আমাদের পুরোনো এলাকায়; সেই চির পরিচিত কেনেডি/ অ্যাগলিন্টন পাড়ায়।
মাঝখানে অনেক অনেক দিন লিখতে বসতে পারিনি, কিছুতেই না।
কত দূরের দেশে গিয়েছিলাম বাবু আমরা, তা–ই না? কী মজা আর আনন্দে কাটল গ্রীষ্মের কয়েকটা ছুটির দিন। তুই ছিলি পুরো গ্রীষ্ম ডালাসে। আমি গেলাম নির্ধারিত দিনে। আমি যাওয়ার দুই দিন আগেই ঢাকা থেকে এসেছিল ছোট বোন আর ওর সন্তান। বড়পা বাদে আমরা বাকি তিন বোন ও চার শিশু রওনা দিলাম আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোয়। সে কী উত্তেজনা! বড় বোন ফ্লোরিডা থেকে এসে পৌঁছাল আর তিন ঘণ্টা পরে।
এবার মোট ১২ জনের দল; চার বোন, দুই বোনজামাই ও ছয়টি শিশু। শুরু হলো আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখার পালা। ১৪ সিটারের বড় ভ্যান নিয়ে যাত্রা করলাম ভরা গ্রীষ্মে। কী আনন্দ, কী আনন্দ!
অবাক করা সত্য কী জানিস, বাবু?
৩২ বছর আগে; আমরা চার বোন তখন স্কুল-কলেজে পড়ি। ঢাকায়ই থাকি। সরকারি চাকুরে বাবা, দিনমান কষ্ট করতেন। অফিসের বাইরে বোর্ডের খাতা দেখা, অফিস শেষে কোথাও ক্লাস নিতে যাওয়া বা ঘরে বসে কোনো সরকারি বইয়ের কাজ করা। মাত্র বাড়তি দুটো টাকার জন্য, একটু সচ্ছলতার জন্য; সেই পরিবারের মেয়ে আমরা।
ছোটবেলায় গ্রীষ্ম কী, জানিনি কোনো দিন। স্কুল ছুটি হলে মা হাঁপিয়ে উঠতেন। চার বোন পিঠাপিঠি ছিলাম বলেই হয়তো মা একটু অবসর চাইতেন। আমি আজ যে বয়সে তোকে চিঠি লিখছি, সেই বয়সের আরও আগেই আমার মা নানি হয়েছিলেন। আমাদের মা পড়ালেখা কম জানা হলেও সব সময় বলতেন, ‘যদি নিজে স্বাবলম্বী না হও, সারা জীবন সংসারের ঘানি টানতে টানতে আর স্বামীর গালমন্দ শুনতে শুনতেই কাটাতে হবে। আমাকে দেখে যদি না শেখো, আর কোথাও গিয়ে শিখতে পারবে না।’
বাবু, আমরা সেই মায়ের মেয়ে। নিজেদের গড়ে তুলতে অনেক অনেক সময় দেওয়ার পরে চার বোন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা নিজেদের টাকায় পৃথিবী দেখব। সারা বছর কষ্ট করব; কিন্তু বছরের কয়েকটা দিন বোনেরা একসঙ্গে কাটাব। যেকোনোভাবেই হোক, একটা নির্দিষ্ট টাকা আমরা এই পৃথিবী দেখার জন্য ব্যয় করব। সেইমতো চলছি গত তিন বছর।
উন্নত দেশে ভ্রমণ যে কত ব্যয়বহুল, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। তবু যখন এই লেখা লিখছি, চোখের সামনে ভেসে উঠছে সিয়েরা নেভেদার পাহাড়ি বর্ডার, আকাশসম আল্পাইন পাহাড়ের চূড়া, লেক তোহার অপূর্ব জলরাশি, লেক আল্পাইনের বিস্ময়কর প্রাকৃতিক শোভা, বিগ ট্রি পার্কে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাছ।
আবার সান ফ্রান্সিসকো শহরের পৃথিবী বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়; যেখান থেকে পাস করেছেন গুগল/ ইয়াহুর ছাত্ররা, যেখান থেকে প্রতিবছর অনেকেই নোবেল পুরস্কার পান, গিয়েছিলাম সেই পাওলো আল্টো শহরে; যে শহরে বাস করতেন অ্যাপলের জনক স্টিভ জবস। যে পথে স্টিভ জবস হাঁটতেন, কফি খেতেন, সেখানে হাঁটতে গিয়ে শরীরে একটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছিল, বাবু জানিস! জন্মেছিলাম এমন একটা দেশে, যা পৃথিবীর ম্যাপে দেখাই যায় না। সেই দেশের মঙ্গাপীড়িত জেলা রংপুরে জন্ম আমার; যদিও জন্মেছিলাম কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে। তাই একটা অহংকার আছে। কিন্তু আজ যখন বিশাল স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঁটছিলাম, তখন কেমন শূন্য অনুভূতি হচ্ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হেঁটেছেন বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, স্টিভ জবস এবং এই সামান্য লুনার পা পড়ল এখানে! তুই এই অনুভূতি বুঝবি না, বাবা!
সান হোসে শহরের বুক চিরে চলে গেছে বে সাউথ/নর্থ প্যাসিফিক সাগর। দেখলাম সান ফ্রান্সিসকো শহরের গোল্ডেন গেট ব্রিজ, কাতারে কাতারে ট্যুরিস্ট দিয়ে ভরে থাকা সেই উত্তেজনাকর শহর। পৃথিবী বিখ্যাত ইউসিমিটি পার্ক, যেখানে হ্যাকিং করে ঝরনা দেখতে যেতে হয়।
জানিস বাবু, পৃথিবী বিখ্যাত এসব ইতিহাসের সামনে দাঁড়ালে তুচ্ছ লাগে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবনকে। ক্যালিফোর্নিয়া শহরের সেই আকাশসম বিগ ট্রির সামনে যখন দাঁড়ালাম, তখন মনে পড়ল আমার মা–বাবার সেই মুখ, ক্লান্তিভরা মুখ। চার মেয়ে জন্ম দিয়ে যাঁরা ভুগেছেন গোটা জীবন। সমাজ বলেছিল মাকে, ‘তোমার তো ছেলে নেই, কী আর করবা, পোড়া কপাল তোমার!’ কী নির্মম সমাজ আমাদের।
আমার মা-বাবা এখন আমাদের আনন্দ দেখেন প্রাণভরে। অরেন্ডা শহরের সেই ১৩৩৮ নম্বর কটেজ বা লজ, কাঠের তৈরি সেই ১৫ বেডরুমের লজের ৫০ মাইলের ভেতর কোনো ফোনের নেটওয়ার্ক ছিল না। কাজ করত ই–মেইল। সারা দিন ঘুরে এসে আমরা সবাই মিলে লজের বারান্দায় বসে আড্ডা মারতাম, মায়ের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলতাম। চার বোন হেসে উঠতাম অকারণ। মা হয়তো মুহূর্তেই ভুলে যেতেন তাঁর দীর্ঘ বছরের বেদনা।
আমার মায়ের মতো কি আমার জীবন, বাবু?
কাল সকালে উঠে অফিসে যাব। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকে দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়ার হিসাব ভুলতে চাই। কিন্তু আমার মা কি পেরেছিলেন সেটা? হয়তো হ্যাঁ বা না।
জীবনের কোনো সঠিক উত্তর নেই বাজান। সময় সময় বয়ে চলা এই জীবনে মনে হয় দিনটা পাড় হয়ে যাক, আবার নতুন সকাল শুরু হোক। কোনো কিছুর হিসাব মেলাবার আগেই যেন চলে যেতে পারি। আদর বাসুন, তোর গ্রেড এইট আনন্দের হবে, এই দোয়া বাবু।
তোর মা
৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২
স্কারবোরো, টরন্টো, কানাডা