বিভূতিভূষণ আমার জীবনে অপু হয়ে এসেছিলেন
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার জীবনে অপু হয়ে এসেছিলেন। কতবার বর্ষায় ভিজে গেলে মনে মনে নিজেকে দুর্গা ভেবেছি। কতবার মনে মনে বলেছি, ‘হলুদ বনে বনে, নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে সুখ নেইকো মনে।’
তারপর শংকর। সাধারণ এক গ্রামের জীবন থেকে আফ্রিকা। বিভূতিভূষণ চাঁদের পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেই হয়তো পূর্ণিমার রাতে চাঁদের মধ্যে পাহাড় খুঁজি। সে পাহাড় আর চাঁদের পাহাড় এক না হলেও মনে হয় চাঁদের মধ্যেই যেন একমাত্র ওই গল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব।
সেই অন্ধকার রাতে গুহার অন্ধকারে দিয়েগো আলভারেজের দেহ আগলে জনমানবশূন্য অরণ্যের মধ্যে শংকরের জেগে থাকা কতবার যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়েছি। এখনো তাঁবুর বাইরে বুনিপের পায়ের তিনটি আঙুলের ছাপ দেখতে পাই।
এরপর বিভূতিভূষণ একদিন সত্যচরণ হলেন লবটুলিয়ার অরণ্যে, ধাতুরিয়া, যুগলপ্রসাদ, রাজু পাঁড়ে, কুন্তা, মঞ্চির মতো রূপকথার মানুষগুলো বন্ধু হলো। আমি ভানুমতী হতে পারলাম না, খুঁজতে থাকলাম তাকে ফুলকিয়া বইহারের জ্যোৎস্নায় ...।
ভানুমতীর কাল্পনিক ট্যান পড়া বাদামি ত্বক চোখের তারায় বসিয়ে আরণ্যকের পাতায়, লবটুলিয়ার জ্যোৎস্নায়, ঘোড়ায় চড়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কতদিন ঘুরেছি...।
নগরজীবনের এক টুকরা ছোটবেলায় গল্পের বইয়ের তত জোগাড় ছিল না। একই বই বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়তাম। তবু একঘেয়ে লাগেনি কোনোদিন। এখনো অবসর পেলে আরণ্যকের পাতায় ডুব দিয়ে শান্তি খুঁজে পাই। জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় প্রকৃতি অনেক পবিত্র, শহরের মতো ওখানে সুবাতাস কলুষিত নয়।
এরপর জীবনের থেকে মৃত্যুর পরবর্তী সম্ভাবনাকে তিনি আমার কাছে গভীর করে তুলেছিলেন, ‘দেবযান’ উপন্যাসে। মৃত্যুর পরবর্তী স্তরে স্তরে বিন্যস্ত ভাসমান ঘরবাড়ি আর অ-প্রাণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠার স্বপ্নসুখ। ‘দেবযান’ আমার চিরকালের ঘুমহীন রাত্রির ফ্যান্টাসি।
এভাবে বিভূতিভূষণকে জেনেছি কতখানি জানি না। কিন্তু তিনি আমাকে যা দিয়ে গেছেন সেসব পড়তে পড়তে বড় হতে হতে এখন বুড়ো হচ্ছি। বিভূতিভূষণকে জানতে চাইলাম তার চরিত্রদের জানার অনেক পরে। সেই জানাটা এখনো ফুরোয়নি। চলছে, চলবে হয়ে রয়েছে...।
এমন একজন লেখক যিনি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেননি এখনো। এখনো জন্মদিন আর মৃত্যুদিনের স্মৃতি বা স্মারকলিপি ছাড়াও আমরা ওনাকে পড়ি। ইছামতীকেও চিনেছিলাম ওর কলম থেকেই। ছুটে গিয়েছিলাম দেখতে। দেখলাম জল নেই। শুকিয়ে গেছে। মরা নদী একটা বড় নালার মতো হয়ে পড়ে রয়েছে বিষণ্ণ বিবশতা নিয়ে। শুধু বিভূতিভূষণ বসে আছেন নদীপারে একা। দেখছেন... দেখেই চলেছেন আমাদের...।
বোয়ালখালী, কধুরখীল, চট্টগ্রাম