আলাপের বেঞ্চিতে পাবলো নেরুদা

পাবলো নেরুদা

চায়ের কাপ থেকে কবিতার কাপলেটে আবর্তনের সময়ে অন্তর্জালে চোখে পড়ে এক কবিকে—পাবলো নেরুদা, বিশ্বসাহিত্যের কালোত্তীর্ণ এক কবি। কবিতায় সময়ের যাতায়াতও যাঁকে এমনভাবে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে, যেন তিনি চিরকালীন কবি। স্মৃতির ভ্রমে বা বিভ্রমে মাঝেমধ্যে মনে হয়, নেরুদা শেষ রাতে হেঁটে এসে বসেন চিলির সমুদ্রতটে, তাঁর সঙ্গে সুদীর্ঘ আলাপ হয় সেই সব জড়োসড়ো নিশান্তিকায়।

চিলির দক্ষিণে বৃষ্টি আর অরণ্যের মিতালির মাঝে জন্মেছিলেন নেরুদা। অরণ্যের বিশালতা আর বৃষ্টির অবিরাম শব্দ তাঁর শিশুমনকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সেখান থেকে আরণ্যস্বভাব তাঁর মধ্যে ঢুকে পড়া খুব অস্বাভাবিক নয়। নেরুদার কবিতা যুবক বয়সকে বোহেমিয়ান হওয়ার হাতছানি দেয়, মানুষের গল্প ও দৃষ্টির বিভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। শৈশবের জানালায় বসে তিনি চোখে বৃষ্টির পতন এঁকেছেন। বনের ভেজা গন্ধ আর বিশাল ফার্ন গাছের মাঝে বৃষ্টির বেহিসাবি আনাগোনার প্রভাব তাঁর কবিসত্তার অনেক শাখা–প্রশাখায় খুঁজে পাওয়া যায়।

পাবলো নেরুদা, কবিতা যাঁর কাছে ছিল প্রেমের মন্ত্র এবং বিপ্লবের অস্ত্র
ছবি: সংগৃহীত

সান্তিয়াগোতে তিনি কাটান বোহেমিয়ান জীবন। ক্ষুধার্ত দিন আর কবিতার নেশায় মগ্ন রাতগুলো কী ভীষণ জীবন্ত ছিল তাঁর জীবনে! মারুরি স্ট্রিটের সেই ছোটঘর আর পাগলপারা বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর সখ্য আমার বর্তমান সময়কে আরেকটু রাঙিয়ে দেয়। পকেটে উচ্ছিষ্টটাও নেই, অথচ হৃদয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। তিনি যখন তাঁর বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুলো লিখছিলেন, তখন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে চলছিল চরম হাহাকার। প্রেম ও প্রকৃতির অদ্ভুত মিশেল কেবল নেরুদার কলমেই সম্ভব। শহরের গলিতে ঘুরে বেড়ানো লাজুক তরুণটি কীভাবে শব্দের জাদুকর হয়ে উঠলেন, তা এক বিস্ময়কর উপাখ্যান।

প্রাচ্যের দেশগুলোতে কাটানো নেরুদার দিনগুলোর কথা জানলে মনটা ভারী হয়ে ওঠে। রেঙ্গুন বা কলম্বোর দিনগুলো ছিল চরম একাকিত্বে ভরা। সেখানে তিনি দেখেছেন ঔপনিবেশিক শাসনের নগ্ন রূপ আর শোষিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস। রাতে ঈর্ষায় উন্মত্ত বার্মিজ প্রেমিকা জোসির হাতে ছুরি নিয়ে মশারির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যেন শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার। এমনকি মানুষের সঙ্গ না পেয়ে তিনি বন্ধুত্ব করেছিলেন কিরিয়া নামের এক বেজির সঙ্গে।

তবে নেরুদার জীবনের সবচেয়ে বড় মোড় ছিল স্পেন আর সেখানকার গৃহযুদ্ধ। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোর্কার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব সাহিত্যের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। লোর্কার প্রাণচ্ছল হাসি আর জাদুকরি ব্যক্তিত্ব নেরুদাকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু ফ্যাসিবাদের নখরে লোর্কার নৃশংস মৃত্যু নেরুদার কবিসত্তাকে পুরোপুরি বদলে দেয় এবং তিনি বুঝতে পারেন যে কবির দায়বদ্ধতা শুধু সৌন্দর্যের প্রতি নয়, বরং মানুষের প্রতিও রয়েছে। মাদ্রিদের রাস্তায় বোমারু বিমানের হানা আর বন্ধুদের রক্তে ভিজে যাওয়া মাটি দেখে তাঁর কলম গর্জে উঠেছিল। কবিতা হয়েছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। স্পেনের গৃহযুদ্ধে ধূলিসাৎ হওয়া মাদ্রিদের হাহাকার আর বন্ধুদের হারিয়ে ফেলার বেদনা তিনি আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি জাহাজে করে হাজার হাজার স্পেনীয় শরণার্থীকে চিলিতে নিয়ে এসেছিলেন।

আরও পড়ুন
পাবলো নেরুদা ও নিকানোর পাররা, ১৯৭৩
ছবি: সংগৃহীত

নেরুদা আজীবন সমুদ্র ভালোবেসেছেন। ইস্লা নেগ্রার বাড়িতে বসে সমুদ্রের গর্জন শোনার বর্ণনা আমার ভেতর কোথাও তীব্র অনুনাদ জাগায়। তাঁর সংগ্রহে থাকা অদ্ভুত সব মুখোশ বা জাহাজের ফিগারহেড বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী। নেরুদা আসলে বহু জীবনের সমষ্টি। তিনি কখনো প্রেমিক, তো কখনো প্রতিবাদী বিপ্লবী, আবার কখনোবা প্রকৃতির পূজারি। এই মানুষটি এক বিশাল ক্যানভাসে আঁকা পৃথিবীর ছবি, যেখানে রং হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে রক্ত, ঘাম আর অশ্রু।

১৯৭১ সালে প্যারিসে রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন নেরুদা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা ছিল তাঁর সারা জীবনের সাধনার স্বীকৃতি। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান তাঁর স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। আয়েন্দের মৃত্যুর মাত্র ১২ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে এক গভীর অভিমান আর বেদনা নিয়ে এই মহাপ্রাণ কবি পৃথিবীকে বিদায় জানান। মৃত্যুর পর তাঁর বাসভবন তছনছ করা হয় এবং তাঁর অমূল্য পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করা হয়, যা ছিল ফ্যাসিবাদের এক নগ্ন রূপ। নেরুদা আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর এই বর্ণিল জীবন আর শব্দের মিছিল চিরকাল আমাদের ধমনিতে স্পন্দন জাগিয়ে যাবে।

শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়