রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি… সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে/ অক্ষয় উৎসাহে...।’ সত্যি তাই। বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি। এর রহস্যের যেন শেষ নেই।
নদীমাতৃক স্নিগ্ধ বাংলাদেশের কথা ভাবলে কল্পনায় ভেসে ওঠে দিগন্তজোড়া সমতল ভূমি, বিস্তৃত সবুজ ধানখেত, পাহাড়ি জনপদ, বহমান নদী, পালতোলা নৌকা, ভাটিয়ালী গান, আকাশের বুক চিরে উড়ে যাওয়া ধবল বকের সারিসহ আরও কত কী। চিরকালই কি এমন ছিল এই বাংলাদেশ?
প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে অপরূপ বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। পৃথিবীজুড়ে আজ যেমন অনেকগুলো মহাদেশ, একদিন কিন্তু এমন ছিল না। তখন পৃথিবী একসঙ্গে এক বিশাল ভূখণ্ড ছিল। প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে সেই ভূখণ্ড প্রায় মাঝখান থেকে ভেঙে যায়। লরেশিয়া ও গন্ডোয়ানা ল্যান্ড নামে সৃষ্টি হয় দুটি বিশাল মহাদেশ।
১৮ কোটি বছর আগে যেদিন গন্ডোয়ানা ল্যান্ড পৃথিবী থেকে আলাদা হয়, সেদিন থেকেই আমাদের এই ভূখণ্ডের জন্মের ইতিহাস শুরু। বাংলাদেশকে আজ আমরা বিষুব রেখার উত্তরে দেখি। কিন্তু এর জন্মের ইতিহাস শুরু হয়েছিল পৃথিবীর একেবারে দক্ষিণ গোলার্ধ অ্যান্টার্কটিকা থেকে। আর গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র শুধু যে এ জনপদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, এই নদীগুলোই একদিন আমাদের জন্মভূমি গড়ে দিয়েছিল। এ জন্যই দেশের নানা সংকট, বিপ্লব-বিদ্রোহে গানে, স্লোগানে বলা হয়, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। এই নদীগুলোই আমাদের অস্তিত্ব, শিকড়, ঠিকানা।
প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে আবার আরেক ঘটনা ঘটে। গন্ডোয়ানা ল্যান্ডে ফাটল তৈরি হয়। তারপর কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হয়। এরই এক একটা অংশ ভারত, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা ইত্যাদি প্লেট নামে পরিচিত। ধারণা করা হয় যে সে সময় ভারত ও অস্ট্রেলিয়া একসঙ্গে ছিল। তারপর এসব ফাটল লাভা বের হতে থাকে। আবার একদিন এসব ফাটলে গভীর সমুদ্র সৃষ্টি হয়। তখন এই গন্ডোয়ানা মহাদেশের এক একটা প্লেট হাজার হাজার মাইল দূরে যেতে থাকে। এই চলার পথে নানা অভিঘাতের মুখে পড়তে হয়।
সে প্রায় ৯ কোটি বছর আগের কথা। তখন একসময় ভারতীয় প্লেটের সঙ্গে বার্মা প্লেটের ধাক্কা লাগে। এতে ভারতীয় প্লেটের তলদেশ বার্মা প্লেটের নিচের দিকে যায়। এ জন্য নাগাল্যান্ড ও আরাকান পর্বতের সৃষ্টি হয়। এভাবে প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে ভারতীয় প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে তিব্বতের সঙ্গে ইউরেশিয়া প্লেটের সঙ্গে দুনিয়া কাঁপানো ধাক্কা খায়। এতে পৃথিবী সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালা হিমালয়ের সৃষ্টি হয়।
তখন হিমালয় থেকে জন্ম হয় গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। গঙ্গার শাখা নদী হলো পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। এসব নদী হিমালয় থেকে কোটি কোটি টন পলি এনে বাংলা অববাহিকায় জমা করে। ভারতের পশ্চিম বাংলা এবং আজকের বাংলাদেশ হলো বাংলা অববাহিকা। হিমালয় ছাড়াও নাগাল্যান্ড, আরাকান পাহাড়, অস্ট্রেলিয়াসহ নানা মহাদেশের পলি এসে আমাদের এই জনপদ জেগে উঠতে থাকে। এভাবে মহাদেশীয় প্লেটগুলোর ভয়ংকর সংঘর্ষে কোটি কোটি বছর ধরে বিভিন্ন মহাদেশের পলি এসে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্ম হয়।
আমাদের এই জনপদ গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। তা না হলে এত বড় ভূখণ্ড হয়তো কোনো দিন সৃষ্টি হতো না। এখনো গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র প্রতিবছর কোটি কোটি টন পলি হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে আসছে। এ জন্যই সাগরে বিশাল বিশাল চর জেগে উঠতে দেখা যায়। তাই বাংলাদেশের মানুষ আসলে সাগরপারের মানুষ। আর রাখঢাক না করে বলা যায় যে আমরা হলাম চরের মানুষ। তবে এ জন্য গর্বেরও সুযোগ আছে। কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দৃষ্টিনন্দন চরে আমাদের বসতি। আমাদের এই চরেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্রসৈকত।
লেখক, সংগঠক ও সাংবাদিক