আদ্রিতার মুখে এ কথা শুনে অন্তরের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে পড়ল। সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। জীবনে এই প্রথম সে এত বড় ধাক্কা খেল।
ছোট্ট একটা ঘর তাদের। মোমেনা রঙিন কাগজ কেটে কেটে বিভিন্ন নকশার ফুল বানাল। আঠা দিয়ে সেগুলো দেয়ালে লাগিয়ে দিল পরম যত্নে। জীর্ণ দেয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি না পেলেও সে মনে মনে দারুণ খুশি। মা সেগুলো দেখে কেবল হাসেন। মোমেনা বাবাকে ফুলগুলো দেখাতে দেখাতে বলে, ‘আব্বা, দেখো, কত সুন্দর না?’
বাবা উদাসমুখে বলেন, ‘কী দরকার?’
মোমেনা হাসিমুখে চলে আসে। আবার ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলে, ‘ভাইয়া, কত সুন্দর না?’
অন্তর ছোট বোনকে প্রশংসায় ভাসায়। সে বলে, ‘কাগজ কেটে এত সুন্দর ফুল বানানো কার কাছে শিখেছিস? আমাকে একটু শিখিয়ে দিবি?’
শুনে মোমেনার মুখখানা হাসিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। উৎসাহ আর আনন্দ নিয়ে সে ভাইকে কাগজের ফুল বানানো শেখায়। অন্তর ওর হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিষ্পাপ, ফুলের চেহারাটা দেখলে খুব প্রশান্তি আসে। বোনটাকে ছেড়ে দূরে থাকতে কীভাবে মন চাইবে? তবু থাকতে হয়। আমরা সুখের জন্য সুখকে বিসর্জন দিই।
অন্তর যেদিন চলে আসবে, সেদিন মোমেনার কান্না থামতে চায় না। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলল। কাউকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখলে বড় মায়া হয়। অন্তর সেই মায়া কাটিয়ে উঠেছে অনেক আগেই। পাঁচ শ টাকার একটা নোট বোনের হাতে গুঁজে দিয়ে সে বলল, ‘আমার লক্ষ্মী বোনটা কাঁদে না। কিছুদিনের মধ্যে আবার আসব।’
মোমেনা টাকাটা হাতের মুঠোয় কচলাতে লাগল আর চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। অন্তর রিকশা করে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলো। সে জানে কান্নাভেজা একজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে একবারও দেখতে ইচ্ছা হলো না। করুণ দৃশ্য খুব বেশি দেখতে নেই। দেখলে সহ্য করার ক্ষমতা রাখতে হয়। অন্তর এখনো ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আদ্রিতার সঙ্গে দেখা। ভদ্রতা রক্ষার জন্যই অন্তর জিজ্ঞেস করল, ‘আদ্রিতা, কেমন আছ?’
‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন, অন্তর ভাই?’
‘ভালো। আন্টিকে দেখলাম না। বাইরে কোথাও গিয়েছে নাকি?’
‘রাফিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য গেছে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আসার সময় কোনো সমস্যা হয়নি তো আপনার?’
‘না, কোনো সমস্যা হয়নি। আচ্ছা আমি যাই। রাফি বিকেলে পড়তে আসে যেন।’ বলেই সে যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল তখন ওর মন নিচেই পড়ে রইল। মনে হচ্ছিল আদ্রিতা বুঝি এখনো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিতা সত্যিই ঠায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। সেটা বুঝেও সে একবার নিচে চেয়ে দেখল না। পাথরে গড়া মন। এত সহজে গলবে না।
দরজা খুলতেই ঘরের মেঝেতে টুকরো কাগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল। এগুলো আদ্রিতার লেখা চিরকুট। দরজার নিচ দিয়ে রেখে গেছে। অন্তর সবগুলো চিরকুট কুড়িয়ে হাতে নিল। তারপর টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিতে দিতে ভাবল এগুলো পড়বে না। পড়বেই না যখন, তাহলে এগুলো ড্রয়ারে রাখার কোনো মানে হয় না। তবে ময়লার ঝুড়িতে রেখে দিলে একটু বেশিই মন্দ দেখায়। ভাবতে ভাবতে চিরকুটগুলো ড্রয়ারেই রেখে দিল। বিছানায় বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এলোমেলো পড়ে থাকা ঘরটাকে গোছানোর কাজে লেগে পড়ল।
দীর্ঘ বাস জার্নি শেষে ঘরের যাবতীয় কাজ শেষ করাটা বিরক্তকর লাগছে। অন্তর চেয়ারে বসেই ঢুলতে লাগল। পড়ন্ত বিকেলের আলস্য ভর করতে লাগল। কিন্তু এখন ঘুমানো যাবে না। রাফি পড়তে আসবে। কিছুদিন পরই ওর পরীক্ষা। পড়ালেখা ঠিকমতো না হলে পরীক্ষায় খারাপ করার আশঙ্কা থাকবে। এমনিতেই চার-পাঁচ দিন ছুটি কাটানো হয়েছে।
চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসে সে বিছানায় বসে রইল। রোদ পড়ে যাচ্ছে। ছাদে এই সময় বাতাস থাকে। না থাকলেও দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। বিকেলটা হচ্ছে ছাদে ওঠার সবচেয়ে ভালো সময়। হঠাৎ মনে হলো আদ্রিতার দেওয়া একটা চিরকুট পড়া যাক। কী লিখেছে, সেটা অবশ্য জানা জরুরি নয়। কৌতূহল মেটানোই মূল উদ্দেশ্য।
হলুদ রঙের কাগজে লিখেছে, ‘অন্তর ভাই, আপনি কবে আসবেন? আপনাকে ছাড়া এই ছাদটা ভীষণ ফাঁকা লাগে।’
আরেকটা হলুদ রঙের কাগজে লিখেছে, ‘মা বলে আপনি নাকি অন্য ছেলেদের চেয়ে আলাদা। আচ্ছা, মার সঙ্গে কি আপনার কথা হয় মাঝেমধ্যে?’
নীল রঙের একটা কাগজে লিখেছে, ‘এই বর্ষায় বৃষ্টি হবে না, আপনি না এলে।’
অন্তর একে একে সবগুলো চিরকুট পড়ল। অনেক কথার সারমর্ম এই যে আপনার স্বপ্নটা কী, তা জানতে ইচ্ছে করে। আপনি আমাকে মোটেও অন্য রকম মেয়ে ভাববেন না। আপনার বিনয়ী ভাব আমার খুব ভালো লাগে। আপনি শুধু বাসাতেই এ রকম, নাকি সব সময়? আপনাকে নিয়ে প্রায়ই ভাবতে বসি। লিখতে লজ্জা লাগছে।
পড়া শেষ হলে এক মুহূর্ত মনে হলো ভালোবাসা মন্দ না। এখন সে কী করবে? মেয়েটির চোখে চোখ রেখে এক মুহূর্তও কথা বলা হয়নি। আদ্রিতা যেমন সুশ্রী, তেমনি বুদ্ধিমতী। কত মিষ্টি করে কথা বলল আজ। যেকোনো ছেলে এই রকম রূপবতী মেয়ের প্রেমে পড়বে। কলেজে যাওয়ার সময় ছেলেরা ওকে কত বিরক্ত করে কে জানে!
তবে মনে ঘোর সংশয় জাগে। মেয়েটা কোনো রকম মজা নিচ্ছে না তো? যদি মজাই নিত, তাহলে এত দিনে হাল ছেড়ে দিত। কারণ, ওর মিষ্টি কথায় কখনো সায় দিতে রাজি হয়নি সে। তা ছাড়া আদ্রিতার ইশারা সুস্পষ্ট। তবু কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হয়।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে অন্তরের হাই উঠল। ছাদের এক কোণে এসে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে মাকে ফোন করল। ফোন রিসিভ করেছে মোমেনা।
‘হ্যালো। ভাইয়া, বাসায় পৌঁছেছ?’
‘হ্যাঁ, কিছুক্ষণ হলো। আম্মার কাছে দে তো ফোনটা।’
মা ফোনে বললেন, ‘ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস আর মন দিয়ে পড়ালেখা করিস, বাবা। তর বাপের কথায় রাগ করিস না। আর একটা কথা, বদ পোলাপানদের সঙ্গে চলাফেরা করিস না।’
ভৈরব আসার পর থেকে মায়ের সবচেয়ে বড় উপদেশ হচ্ছে, বদ পোলাপানদের সঙ্গ পরিহার করে চলা। অন্তর প্রতিবারের মতো এবারও বলল, ‘তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমার কোনো বন্ধু নাই।’
‘বন্ধু নাই কেমন কথা? বন্ধু রাখতে তো নিষেধ নাই। বদ পোলাপানদের সঙ্গে মিশলে বদ নেশায় ধরে। অনেক দেখছি।’
‘আচ্ছা, মা। এখন ফোন রাখছি।’
আজ রাফির পড়া শেষ হতে একটু বেশি সময় লাগল। ততক্ষণ আদ্রিতা কাঠের একটা চেয়ারে বসে রইল। অন্তর রাফিকে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি ছাদে একটু হাঁটাহাঁটি করো। তোমার আপু এখনই চলে আসবে।’
রাফি তাই করল। ছাদের এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আদ্রিতা সামান্য ঘাবড়ে গেল। ওর চোখে এই লোকটাকে এখন কঠিন বলে মনে হচ্ছে। হৃৎস্পন্দন দ্বিগুণ বেড়ে গেল হঠাৎ। অন্তর বলল, ‘আদ্রিতা, তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’
‘কী কথা, স্যার?’
‘তুমি যে আমাকে এত এত চিরকুট লিখো, এগুলোর মানে কী?’
‘চিরকুট? কিসের চিরকুট স্যার? আমি তো আপনাকে কখনো কোনো চিরকুট লিখিনি।’
‘বলো কি! তাহলে কে লিখে?’
‘আমি কী করে জানব? আচ্ছা, স্যার, কাজের মেয়েটা দেয় কি না জিজ্ঞাসা করে দেখব একবার?’
আদ্রিতার মুখে এ কথা শুনে অন্তরের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে পড়ল। সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। জীবনে এই প্রথম সে এত বড় ধাক্কা খেল। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বলার মতো আর কিছুই খোঁজে পেল না।
অন্তরের শুকনা মুখটা দেখে আদ্রিতা হেসে লুটিয়ে পড়ল। ওর হাসি যেন থামতেই চাইছে না। অন্তর দুচোখ ভরে সেই হাসি দেখতে লাগল। নিজের নির্বুদ্ধিতাকে নিজেই কটাক্ষ করল মনে মনে।
‘যাই, স্যার।’ বলে প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে আদ্রিতা রাফিকে নিয়ে নিচে চলে গেল। এদিকে অন্তর অনেকক্ষণ ঘোরের মধ্যে পড়ে রইল। এই প্রথম আদ্রিতাকে সে এত বেশি হাসতে দেখেছে। ওর কানে সেই হাসির রেশ এখনো রয়ে গেছে।
চলবে...
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা