সেদিন মামি গরুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না করলেন। শিমের বিচি, ছোলা আর চাল ভাজলেন। বৃষ্টির দিনের সব আয়োজন চলল বেশ আনন্দের সঙ্গে। অন্তর কিছুটা বিস্ময় নিয়ে সেসব দেখতে লাগল। খাবার টেবিলে একসঙ্গে বসে প্রত্যেকেই নিজের ঝুলি থেকে দু-একটা গল্প বের করল। মামি বিজ্ঞদের মতো দুয়েকটা ধাঁধাও জিজ্ঞেস করলেন। একটা ধাঁধা ছিল এমন, ‘বন থেকে বের হলো টিয়ে, সোনার টুপুর মাথায় দিয়ে।’ ধাঁধার মারপ্যাঁচে পড়ে অন্যরা বিষম ভাবনায় পড়ে গেল। অন্তর বলল, ‘আনারস’। উত্তর সঠিক হয়েছে দেখে নীলা আর মিলার চোখে বিস্ময় খেলে গেল।
সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বর্ষার অঝোর ধারা থেমে এল প্রায়। অন্তর চলে আসার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। সকালে দুটি টিউশন শেষ করতে হয়। সেখানে ওর বিশেষ গুরুত্ব আছে। তাই ওকে কোনোমতেই আটকে রাখা গেল না। আসার সময় নীলা বারবার বলে দিল, যেন সে মাঝেমধ্যেই বেড়াতে আসে। মামার বাড়িতে আসতে তার কী এত সমস্যা! অন্যদিকে মিলা রাগ করে বসে রইল। সে কিছুতেই ভাইকে যেতে দিতে রাজি না। শেষে ওকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্তর বেরিয়ে পড়ল বাসার উদ্দেশে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে শহরের চেহারাটাই বদলে গেছে। মনে হচ্ছে, সবকিছু ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভালো ড্রেনেজব্যবস্থা না থাকায় তুলনামূলক কিছুটা ঢালু রাস্তায় হাঁটুসমান পানি জমে আছে। সেসব পেরিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে অন্তর ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বাসায় এসে নিজেকে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিল। টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে পান করে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। বুকশেলফের দিকে তাকাতেই ‘মিসির আলি সমগ্র’ বইটার দিকে নজর গেল। হুমায়ূন আহমেদের লেখা বেশ ভালো লাগে ওর। বিশেষ করে ‘মিসির আলি’ সিরিজের বই। এই চরিত্রের মাধ্যমে লেখক বেশ রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করেন। পড়তে ভালো লাগে।
বইটা খুলে কয়েক পৃষ্ঠা পড়তেই ঘুমে চোখ বুজে এল। সে বইটাকে হাতের কাছে রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। বৃষ্টি থেমে থাকলেও আকাশে মেঘ জমে ছিল। পুনরায় টিনের চালে রিমঝিম শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। সেই সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস বইছে। জানালা খোলা। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে অন্তর।
বেশ কিছুক্ষণ পর মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার ঘরে মশাদের উৎসব লেগেছে যেন। কানের কাছে এসে অদ্ভুত গান শুনাচ্ছে। অন্তর বাতির সুইচ অন করতেই বিছানার দিকে নজর গেল। একটুকরা হলুদ কাগজ পড়ে আছে। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল সেখানে লেখা, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’।
অন্তর একটু মুচকি হাসল। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে এখনো। ছাতা হাতে নিয়ে বাইরে থেকে একটু ঘুরে এলে কেমন হয়?
অন্তর বেরিয়ে পড়ল ছাতা হাতে নিয়ে। শহরময় বৃষ্টি হচ্ছে। সে ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছে। ওর গায়ে বৃষ্টি পড়ছে না। ছাতায় বৃষ্টির ফোঁটা সুর-তান-লয় রক্ষা করে আপন ছন্দে নৃত্য করছে। চারদিক আলোকশূন্য হয়ে আছে। এ সময় আদ্রিতার কথা ভাবতে ইচ্ছা হচ্ছে। অন্তর বুঝতে পারে না, ওর প্রতি আদ্রিতার মোহ নাকি অন্যকিছু। মেয়েরা সাধারণত একটা সময় খুব বেশি কৌতূহলী হয়। তারপর একদিন সব কৌতূহলের সমাপ্তি ঘটলে নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখার কঠিন শপথ গ্রহণ করে ফেলে।
সকালে পড়া শেষ করে রাফি বসে রইল। অন্তর বলল, ‘আপুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেন? ইচ্ছা করলে তুমি নিজেই তো নিচে চলে যেতে পারো।’
রাফি বলল, ‘মা আর বাবা আমাকে বলেছে, একা একা কখনোই যেন সিঁড়ি দিয়ে চলাচল না করি।’
‘ও আচ্ছা। তোমার আপু আজ এখনো আসছে না কেন?’
‘আপুর জ্বর এসেছে। দেখলেন না আজ বুয়া এসে আমাকে দিয়ে গেছে। আবার বুয়া এসে নিয়ে যাবে।’
‘হঠাৎ জ্বর এসে গেল!’
‘আপু কাল বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে এসেছিল। আব্বু বকেছে।’
‘তাহলে বৃষ্টিতে ভিজেই জ্বর বাঁধিয়েছে।’
দরজায় রাফির মা নাছিমা বেগম এসে দাঁড়ালেন। অন্তর রাফির ব্যাগটা হাতে নিয়ে অন্য হাতে হাতটা ধরে ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
নাছিমা বেগম হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?’
অন্তর বলল, ‘জি ভালো।’
‘আর তোমার ছাত্রের?’
‘ওরও ভালো চলছে। ও তো এখন ব্রিলিয়ান্ট।’
‘এর পেছনে তোমারও অনেক পরিশ্রম আছে। মাস এখনো শেষ হয়নি। তুমি কীভাবে চলো না চলো, তা তো জানি না। তুমি তো এক দিনও আমার কাছে কিছু বলো না।’ এ কথা বলে নাছিমা বেগম এক হাজার টাকার তিনটা নোট অন্তরের হাতে দিয়ে বললেন, ‘টাকাটা রাখো।’
কৃতজ্ঞতায় অন্তরের চোখ ছলছল করতে লাগল। এই মুহূর্তে ওর টাকার বিশেষ প্রয়োজন আছে। মাকে কিছু টাকা পাঠানো খুব দরকার। বাবার সামান্য রোজগারে সংসার কিছুতেই চলে না। তার ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ভীষণ কষ্টের জীবন। এই সপ্তাহেই বাড়ি যাবে বলে মনস্থির করে ফেলল সে।
অন্তরকে দেখে ছোট বোন মোমেনা দৌড়ে এসে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল যে ওর হাত ছাড়াতে পারছে না। বাধ্য হয়েই সে বলল, ‘বোন, এবার আমাকে ছাড়।’
মোমেনা হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে দেখতে পারো না। একটুও আদর করো না। কত্তদিন পরে বাড়িতে আসছ!’
‘কীভাবে আসব বল? কলেজে ক্লাস করতে হয়, টিউশনি আছে। এসব ছেড়ে কি আসা যায় সহজে?’
মোমেনা চোখ মুছতে মুছতে ভাইয়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘরের দিকে এগোতে লাগল আর মাকে ডাকতে শুরু করল। মা ঘর থেকে বিরক্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, কী হইছে?
‘ভাইয়া আইছে দেখো।’
মা দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হলেন। অন্তর মাকে পায়ে ধরে সালাম করল। মায়ের মুখখানা দেখে ওর আনন্দ যেন বাঁধ মানে না। ‘তুই আসবি, ফোন তো দিলি না।’
‘ফোনটা ভুল করে বাসায় রেখে আসছি।’
মা অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘অ খোদা!’ তারপর হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘চল, ঘরে চল। দেখ, তোর বাপে আইজ বাজার করছে।’
‘তাই নাকি! তোমার হাতের রান্না আজ বেশ মজা করে খাব।’
জবাবে মা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। তারপর ছেলের পছন্দের খাবার রান্নার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
রাতে চারজন একসঙ্গে খেতে বসল। মোমেনাকে আজ খুব প্রফুল্ল লাগছে। বাবা অবশ্য একটু গম্ভীর হয়ে আছেন। মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত। ভালোভাবে খাচ্ছেনও না। এক লোকমা মুখে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ চিবুচ্ছেন। মাঝেমধ্যে পানি খাচ্ছেন। মোমেনা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, ‘আব্বা, ভাই আমার জন্য কাপড় আনছে। ১০০ রঙিন কাগজ আর একটা আঠা আনছে। এবার ঘরটারে ফুল দিয়া সাজাইয়াম। কাগজের ফুল কত সুন্দর না? আম্মার জন্য একটা শাড়ি আর তোমার জন্য একটা লুঙ্গিও আনছে।’
লুঙ্গির কথা শুনে বাবা একবার অন্তরের দিকে তাকালেন। তারপর আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি কিছুই বোঝা গেল না। মা বললেন, ‘লুঙ্গিটা খুব সুন্দর। আগে খাও, পরে দেখাইতাছি।’
বাবা অন্তরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কয় দিন থাকবি?’
‘দু-চার দিন। সামনেই পরীক্ষা আমার।’
‘কয়েক দিন পরপর খালি পরীক্ষা চলে। এখনো পড়া শেষ অইছে না? চাকরিটাকরি কবে পাইবা?’
‘অনার্স শেষ হতে আরও বাকি আছে। তারপর চেষ্টা করব।’
‘আচ্ছা, দেখো। আর এখন যে তুমি দুই-চার আনা টাকা পাঠাও, তা দিয়া কিছুই অয় না।’
এ কথা শুনে অন্তর নিরুত্তর হয়ে রইল। সে জানে, বাবা মনেপ্রাণে চায় ছেলে রোজগার করুক, ভালো চাকরি করুক। তা ছাড়া বাবার মনে দৃঢ় বিশ্বাস, কেবল অন্তরই এক দিন পরিবারের সব অভাব দূর করতে পারবে। তাই বর্তমান অবস্থার কথা তীর্যকভাবে মনে করিয়ে দিতে চান বারবার।
চলবে...
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা