করোটির কথামালা (পর্ব তিন)

অলংকরণ: তুলি

শেষ লেখায় বলেছিলাম, জাহান নামের এক নারী জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে এলোমেলো আচরণ করছেন। জাহান কানাডা সরকারের কাছে প্রতিবন্ধী বা ডিজঅ্যাবল মানুষ হিসেবে আবেদন করেছেন, তাঁকে যেন সরকার সেই কোঠায় ফেলে কিছু বাড়তি সুবিধা দেয়। কিন্তু জাহান জানেন না তাঁর সেই পথ কত দূর।

কিন্তু গতকাল যে মধ্যবয়সী শ্রীলঙ্কান লোককে দেখে এলাম, তাঁর পাগল হতে কত দিন লাগবে? নাকি সে বিপদ কাটিয়ে উঠবেন কোনো একদিন? কোনটা সত্য হবে তাঁর বাকি জীবনে?

ভদ্রলোকের বয়স ৩৬-৩৭ বছর হবে। দেড় বছরের বাচ্চাকে গত সাত মাস দেখতে পারেননি। হাত নেড়ে নেড়ে একটা বড় গ্রুপ সেশনে বসে বলছিলেন, ‘জানেন আপনারা, এই দেশ আমাকে নিজের সন্তান দেখতে দেয় না। কারণ, আমার বউ মনে করে, সন্তান আমার কাছে নিরাপদ নয়। কী বলেন আপনারা? বউয়ের সঙ্গে আমার সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু আমার সন্তান? আজকে একই শহরে থেকেও আমি জানি না আমার সন্তান গত ছয় মাসে কত বড় হয়েছে?’

লোকটার চোখের কোণ কি ভিজে এসেছিল?

গায়ানা থেকে এসেছেন আরও একজন ভদ্রলোক। এটা তাঁর তিন নম্বর বিয়ে। আগের ঘরের সন্তানেরা আছে; তৃতীয় বউ বারবার আগের সন্তানদের নিয়ে খোঁটা দেন, আগের বউদের নিয়েও যা ইচ্ছে তাই বলেন। এভাব বিয়ের সাত মাসের মাথায় গায়ানা থেকে আসা এই ৫০ বছর বয়সী লোক পারিবারিক নির্যাতনের মামলায় আটকে যান। এখন বিপদ আর বাধাই তাঁর একমাত্র সঙ্গী। পুলিশ তাঁর পিছু ছাড়বে না বেশ কয়েক বছর। যদি খুব কপাল ভালো হয়, তবে আগামী ছয় বছর পরে এই লোক পুলিশের রেকর্ড থেকে মুক্তি পাবে।

শরিফ এসেছেন পাকিস্তান থেকে। খুব ভালো চাকরি করতেন। তাঁর বউও নাকি ভালো চাকরি করতেন। সেই নারীও পাকিস্তানি। শরিফ গতকাল সেশনে বসে কানাডায় স্বামী-স্ত্রী যে সমান সমান, মানে সবকিছু ৫০-৫০, এটা নিয়ে খুব জোর আলোচনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।

দোভাষী হিসেবে একজন বাঙালি ক্লায়েন্ট নিয়ে পেছনে বসেছিলাম, তাই শরিফের পেছনটা দেখতে পাচ্ছিলাম। বারবার দেখছি একটু মোটা শরীর, কথার তোড়ে একবার টান টান সোজা হচ্ছে আবার একটু যেন শিথিল হচ্ছে। মানুষ যখন উত্তেজিত হয়ে কথা বলে, তখন কি মানুষের শরীরে সেটা প্রকাশ পায়?

আরও পড়ুন

শরিফ বলছিলেন, ‘এই যে আপনারা বারবার বলছেন ছেলেমেয়ে ৫০-৫০, তাহলে আমি বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রী ওর এত ভালো জব ছেড়ে দিল কেন? ও কেন মনে করল যে এখন বিয়ে হয়েছে, সব অর্থনৈতিক দায়িত্ব আমার একা পালন করতে হবে? এই কালচার সে পাকিস্তান থেকে বহন করে নিয়ে এসেছে। এই কালচারে সে বড় হয়েছে এবং আমিও বড় হয়েছি এই কালচারে। যেখানে আমি জানি, পুরুষ মানেই সব ক্ষমতার অধিকারী; কিন্তু এর পরেও আমি তো মানুষ! আর কত স্ট্রেস নিতে পারি? গাধার মাতো বাড়তি উপার্জনের জন্য মুখে জোয়াল লাগিয়ে ঘুরতে থাকি। এভাবেই একদিন বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া বেধে যায়। ব্যস, বউ ৯১১ কল করে। আমি এখন পথে পথে ঘুরছি। একটা বাচ্চাকে দেখতে পারছি না আজ আট মাস। এটা কি কোনো জীবন হলো? কিসের ৫০-৫০ বোঝান আপনারা? আমার বউয়ের বাড়তি সুবিধা ৯১১ কল করা। এই সুবিধা আমার কোথায়?’

আমার পাশে তখন বসে কাশেম ভাই। বাংলাদেশ থেকে সদ্য এসেছেন। দুই বছর হবে। একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন, বয়স ৩৫ বছর। পাড় (পার্টনার অ্যাসাল্ট রেসপন্স) প্রোগ্রাম। আগামী ছয়টা শনিবার ভোরে উঠে যেতে হবে, সকাল পৌনে আটটায় রওনা করলে সাড়ে নয়টায় পৌঁছাব। দোভাষীর এই গ্রুপ সেশনগুলোর কাজ পেলে মন লাগিয়ে করি। কারণ, এই কাজে একসঙ্গে ১৬টা ক্লাসের জন্য সাইন আপ করতে হয়। এবারের কাজ বাসা থেকে অনেক দূরে, যেতে প্রায় ৯০ মিনিট লাগবে, তিনটা বাস বদল করতে হবে। তবু ভীষণ ভালো লাগে। খুব ভোরে এই শীতের আগমনী শহর দেখতে দেখতে বাসের ভ্রমণ, কত বিচিত্র মানুষ, কত বিচিত্র জীবনের আয়োজন। ভোরে যখন বাসে উঠি, তখন দেখতে পাই, এই একই পথে কত মানুষ, কত কত মানুষের মুখ—সবাই জীবনকে টেনে নেওয়ার জন্য ছুটছে। সেই একই যাত্রায় কাশেম ভাইকে পেলাম আবার।

যেখানে বসেছিলাম গতকাল, সেই বড় হলরুমে, সেখানে আরও ২৬ জন অংশগ্রহণকারী আছেন; সবার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে কেবল পার্টনারের সঙ্গে ভুল আচরণের কারণে।

যে বড় হলরুমে বসার আয়োজন হয়েছে, সেখান থেকেই একফালি বড় মাঠ দেখা যায়। কী অপূর্ব সুন্দর সকাল, মাঠে ছড়িয়ে আছে সোনালি সোনালি ম্যাপলের পাতা। শান্ত নীরব এলাকা। দূরে তাকালে সোনালি গাছ, এখন পাতা ঝরে যাচ্ছে, শুকনো পাতা। জীবনকে মনে হয় কবিগুরুর সেই গানের মতো ‘ঝরা পাতা গো ঝরা পাতা, আমি তোমার–ই দলে’।

গতকাল সেশনে বসে ভাবছিলাম, এই ১০ বছরে অন্তত ২০ জন বাঙালি পুরুষ, যাঁরা নিজেদের বউকে নির্যাতন করার জন্য পুলিশি কেসে জড়িয়েছেন, তাঁদেরকে কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে। সবার চিত্র কি এক? আর কাশেমের নিরীহ চেহারার দিকে চেয়ে ভেবেছি, কী করবে এই লোক বাকি জীবন?

বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে কাশেম সুতার ব্যবসা করতেন। বিয়ে করেছেন পাঁচ বছর আগে, শানু নামে কানাডিয়ান সিটিজেন এক মেয়েকে। শানুর মা–বাবা এবং গোটা পরিবার টরন্টোতে থাকে। জানি না কী কাজ করে শানুর বাবা বা কী করতেন তিনি। ছেলেমেয়েদের নাকি তেমন মানুষ করতে পারেননি। তাই বাংলাদেশের নিরীহ গোবেচারা ছেলে কাশেমকে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কানাডায় নিয়ে এসেছে। পাঁচ বছরের একটা সন্তান আছে কাশেমের। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়ার একপর্যায়ে শানু পুলিশ কল দিয়ে কাশেমকে ধরিয়ে দিয়েছেন। এখন কাশেম উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে থাকেন।

যেখানে বসেছিলাম গতকাল, সেই বড় হলরুমে, সেখানে আরও ২৬ জন অংশগ্রহণকারী আছেন; সবার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে কেবল পার্টনারের সঙ্গে ভুল আচরণের কারণে। মানুষ হিসেবে তাঁরা যত ভালোই হোক, তাঁরা পার্টনারের কাছে একজন নির্যাতনকারী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের কাশেম তাঁদের একজন।

আগামী ছয়টা শনিবার—সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত থাকব এই সেশনে। আর বারবার নিজেকে বলব, ডলার, টাকা, দামি গাড়ি, মিলিয়ন ডলারের বাড়ি, সুন্দরী বউ বা স্বামী—এর কোনো কিছুই মানুষকে সঠিক পথ চেনাবে না। পথ হতে হবে সৎ, সৎ এবং সৎ।

৫ নভেম্বর ২০১৭

টরন্টো, কানাডা