করোটির কথামালা (পর্ব দুই)

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

শেষ লেখায় বলেছি, ‘ক্রমাগত চোখ ঝাপসা হতে থাকে। কোনো অনুভূতি আর কাজ করে না।’

কিন্তু জীবনকে আসলে এটুকু বলেই শেষ করা যায় না। প্রবল আবেগ নিয়ে লেখা শেষ করার পরও খুব আবেগহীন হয়ে দিনের অনেকগুলো কাজ সারতে হয়। ডলার উপার্জন করে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভীষণ রূঢ় হতে হয়। আর সেটা মানুষের সঙ্গেই।

‘করোটির কথামালা’ লেখায় সরাসরি ঘটনায় ঢুকে যাব ভেবেছি। একদম মেদহীন চর্বিহীন ঘটনার বিবরণ লিখব। কোনো ভূমিকা ছাড়াই। আসলেই কি সেটা পারা যায়? অন্তত আমি যা করি বা দেখি এই শহরের চাকরিজীবনে!

ধরুন, এই শহরে যে মানুষ প্রতিদিন ডেন্টাল হাইজেনিস্টের কাজ করেন গড়ে আট ঘণ্টা করে, আর সেটা এই এলাকা মানে স্কারবোরোতে; যেখানে ৮০ ভাগ সাউথ এশিয়ান বাস করে। এই এলাকার কোনো ডেন্টাল হাইজেনিস্টকে গিয়ে যদি আপনি বলেন, এই শহরের বাঙালি, পাকিস্থানি আর ভারতীয় পরিবারগুলোয় দাঁতের চিকিৎসার কোনো দরকার নেই, নতুন মাইগ্রেট করে আসা সাউথ এশিয়ানদের দাঁত ভীষণ পরিষ্কার ও সুস্থ থাকে, তখন সেই ডেন্টাল হাইজেনিস্ট কিন্তু আপনাকে সরাসরি পাগলও বলতে পারেন! আপনার অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

তেমনই হয়েছে আমার দশা। সারা দিন কস্টির কাজ। যেখানে নতুন অভিবাসীদের একটাই অভিযোগ, এই শহরে চাকরি নেই, ডলার নেই, এই শহরে পায়ের নিচে মাটি নেই; সঙ্গে প্যাকেজ ডিল হিসেবে সময় সময় পারিবারিক সমস্যার কথাও শুনতে হয়।

কিন্তু এই যে দোভাষীর কাজ যা করতে ভীষণ ভালোবাসি, সেই কাজ তো সরাসরি বাংলাদেশিদের সঙ্গে। এখানে তো লুকোচুরির কিছু নেই। আজ যার সঙ্গে কাজ করে এলাম, সে যদি এই লেখা পড়ে, তাহলে প্রথম তিন বাক্যেই বুঝতে পারবে যে জায়গা আর নাম বদলে তাকেই লিখেছি। তাহলে কি কাজটা আমার জন্য খুব সহজ? বারবার কি নিজেকে বলতে হয় না, মিথ্যা যেন না লিখি? তাই আবারও বলি, লেখালেখিতে বড় মুশকিল হচ্ছে, কেবল চোখ ঝাপসা করলেই চলে না, সঙ্গে আরও কিছু চলে আসে।

আরও পড়ুন

জাহান আপাকে আজ বেশ কয়েকবার ধমক দিলাম, যদিও এটা চাকরির ভেতর পড়ে না। আবার কানাডা শহরে ক্লায়েন্টের সঙ্গে গলা উঁচু করা ভীষণ অপরাধ। সত্যিই ভীষণ খারাপ বোধ করছিলাম।

জাহানের বয়স মাত্র ৩৫। বাংলাদেশ থেকে ২০১২ সালে কানাডার অন্য একটা প্রদেশে এসেছে। মাত্র আট মাসের মাথায় স্বামী সেখানেই থেকে গেছে, কিন্তু জাহান চলে এসেছে টরন্টোয়। এখানে নাকি তার ভাই থাকে। যদিও জাহান নিজে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে এবং এই শহরে সে কোনো দিন কাজ করেনি। ভীষণ অসুস্থ বলে ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোগ্রামে আবেদন করেছে। কিন্তু সরকারি ভাতা নিচ্ছে চার বছর ধরে।

জাহান যে অসুস্থ, সেটা মুখে বলার দরকার নেই। এমনকি সে যে মানসিক ভারসাম্যহীন, সেটাও বলে দেওয়া যাবে মাত্র ২০ মিনিট পরই। কিন্তু তাতেই কি কানাডা সরকার জাহানকে মাস গেলে ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোগ্রামের এতগুলো ডলার ফ্রি ফ্রি হাতে তুলে দেবে?

জীবন যদি এত সহজ হতো, তাহলে তো অনেক সমস্যা সত্যিই মিটে যেত। সরাসরি এসব বিষয়ের সঙ্গে কাজ করছি ১৫ বছর ধরে। কানাডা সরকারের ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোগ্রামে টিকতে হলে কী কী বিষয় কাগজে–কলমে ও বাস্তবতায় প্রমাণ করতে হয়, সেটা কি ভাবা যায় একবারও? কতবছর আইনজীবী আর কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, জানা আছে কারও?

আমি খুব চাই, এসব লেখা এই শহরের অন্তত একজন মানুষ পড়ুক এবং বলুক, আপা, আপনি যা লিখছেন, সব বানোয়াট!

হ্যাঁ, ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোগ্রামে কেউ উত্তীর্ণ হবে না কেন? অবশ্যই হবে। আজ যদি আমার ক্যানসার ধরা পড়ে, বিশাল হাসপাতাল থেকে যদি একটানে বড় চিকিৎসক লিখে দেন যে আমি বাকি জীবন কাজ করতে পারব না, কস্টি অফিস যদি সব যাচাই করে দেখে শক্তিশালী রেফারেন্স লেটার দেয়; মাত্র ১৫ দিনের মাথায় সরকারি সব ধরনের সুবিধা পাওয়া শুরু করব আমি। কিন্তু জাহানের বিষয়টা কি তা–ই?

কালো লিগ্যাল এইড কর্মী শ্যালিনকে কি কোনো দিন বোঝাতে পারব আমার দেশের মেয়েদের চিত্র কেবল জাহানরাই না? কী করে বোঝাব সেটা?

এই শহরে নাকি ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোগ্রামে টেকার জন্য অনেকে পাগল সাজে, অনেকে মামলা গুছিয়ে আইনজীবীর কাছে যায়, অনেকে নাকি পাগলের অভিনয় করতে করতে সত্যিই একদিন পাগল হয়ে যায়!

জাহান যখন লিগ্যাল এইড কর্মীর কাছে একের পর এক কথার মারপ্যাঁচে ধরা খেয়ে যাচ্ছে, বারবার যখন কালো ছিপছিপে মহিলা শ্যালিন বলছে, ‘তোমার কাগজ, তোমার মুখের কথা এবং ২৫টা ওষুধের ডিব্বা; কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। তুমি মুখে যা বলছ, তোমার চিকিৎসকের কাগজ সেটা বলছে না। তোমার ওষুধের গায়ে যে তারিখ লেখা, তুমি সেখান থেকে এক বছর বাড়িয়ে কথা বলছ। তোমার কোনো প্রমাণ মিলছে না। কেন সত্য কথা বলছ না?’

তখন আমি ধমকে উঠে বলি, ‘কে আপনাকে শিখিয়ে–পড়িয়ে এখানে পাঠিয়েছে, বলুন। কেন বারবার আপনি স্ববিরোধী কথা বলছেন, কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন আপনি? কতবার আপনাকে একই কথা বলা হচ্ছে, বলেন তো আপা!’

আসলে হয়তো এই মুহূর্তেও লিখতে পারছি না। কথামালা এলোমেলো হচ্ছে। করোটিতে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। বারবার জাহানের চেহারা ভেসে উঠছে করোটির আয়নায়। মনে হচ্ছে, কতটা বিপদে পড়লে জাহান এতখানি পানির নিচে নেমেছে! কেন পৃথিবীতে আমার দেশের মানুষেরাই কেবল পড়ে পড়ে মার খেতে শিখবে? কেন উঠে দাঁড়াতে শিখব না আমরা? যতক্ষণ জাহান সামনে বসে ছিল, মনে হচ্ছিল, আমি যেন বসে আছি নোয়াখালীর চৌমুহনীতে! এটা কি কানাডা শহর?

ভুলে গিয়েছিলাম দুই ঘণ্টার জন্য। কালো লিগ্যাল এইড কর্মী শ্যালিনকে কি কোনো দিন বোঝাতে পারব আমার দেশের মেয়েদের চিত্র কেবল জাহানরাই না? কী করে বোঝাব সেটা? শ্যালিনও তো আমাকে সেই ডেন্টাল হাইজেনিস্টের মতোই পাগল ভাবতে পারে, তা–ই না?

২৪ অক্টোবর, ২০১৭

টরন্টো, কানাডা