সত্যের পথে প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন যতীন সরকার
‘স্যারকে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলেই বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলতেন, “জানো না, ভালো নেই?” তাঁর ভালো না থাকার পেছনে ছিল এক গভীর কারণ। তিনি তখন আর লিখতে পারতেন না। এ কারণে জীবনও যেন থমকে গিয়েছিল। শরীর আরও দুর্বল হলে পড়তেও পারতেন না। এটি ছিল তাঁর জীবনের শেষ আক্ষেপ।’ ময়মনসিংহ জেলা উদীচী সভাকক্ষে কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক যতীন সরকারের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনার কেন্দুয়ার চন্দপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া যতীন সরকার ছিলেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। শিক্ষকতা করার সময় হেঁটে কলেজে যেতেন। থাকতেন ময়মনসিংহ নগরীর সেহড়া হিন্দুপল্লিতে। অন্য যেকোনো লেখক-সাহিত্যিকের মতো তিনি ঢাকায় পাড়ি জমাননি। বিলাসী জীবন পছন্দ করতেন না। শ্রেণির পাঠদান শেষে যতটুকু সময় পেতেন সাহিত্য–সংস্কৃতির কাজ করতেন।
জীবনের দীর্ঘ সময় মননশীল সাহিত্যচর্চা, বাম রাজনীতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দুই মেয়াদে তিনি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান।
একজন যতীন সরকার সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিবেদিত কাজ করেছেন। মানবাধিকার, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
যতীন সরকারের শৈশব শুরু হয় রামপুর ফ্রি বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাসের পর টিউশনি করে পড়াশোনা চালিয়ে ১৯৫৫ সালে নেত্রকোনা সরকারি কলেজে আইএ এবং ১৯৫৭ সালে আনন্দ মোহন কলেজে বিএতে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা নেন। ১৯৬৩ সালে এমএ শেষ করে ময়মনসিংহের গৌরীপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৬৪ সালে নাসিরাবাদ কলেজের প্রভাষক হিসেবে দীর্ঘ শিক্ষাজীবনের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেন।
১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে যতীন সরকার ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। তাঁর উপস্থিতি শহরে প্রতিটি সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক প্রোগ্রামে অনিবার্য ছিল। ময়মনসিংহ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি এবং দীর্ঘকাল ধরে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন।
লেখক হিসেবে যতীন সরকার ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদক, ২০০৫ সালে ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’ গ্রন্থের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন।
যতীন সরকারের লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবনে। প্রথম বই ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, তাঁর বয়স তখন ৫০ বছর। এরপর প্রকাশিত হয় অর্ধশতাধিক বই। উল্লেখযোগ্য হলো ‘বাংলাদেশের কবি গান’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘মানব মন’, ‘মানব স্বপ্ন ও সমাজ বিপ্লব’, ‘পাকিস্তানের জম্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা’, ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ’, ‘বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ‘ভাবনার মুক্তবাতায়ন’।
যতীন সরকার শুধু লেখেননি, বরং সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ ও তত্ত্বমূলক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শব্দ, সমাজ ও সত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অবিচল।
একজন যতীন সরকার সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিবেদিত কাজ করেছেন। মানবাধিকার, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। শিল্পপ্রেমী চিন্তকদের কাছে তিনি স্মরণীয় প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার ১৩ আগস্ট বুধবার বেলা পৌনে তিনটায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কিডনিসংক্রান্ত জটিলতাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগে তিনি সেখানে ভর্তি ছিলেন। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য ভক্ত-গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর মেয়ে ময়মনসিংহ দায়রা আদালতের অতিরিক্ত বিচারক।
সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা