প্রজন্মের হৃদয়ে চিরজাগরূক রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)ছবি: সংগৃহীত

আজ এত বছর পরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান আমাদের নিঃসঙ্গ দুপুরে হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। তাঁর কবিতা প্রেমিক-প্রেমিকার চোখে জল এনে দেয়, তাঁর নাটক মঞ্চে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমরা অনুধাবন করি, রবীন্দ্রনাথ শুধুই এক ইতিহাসনামা নন, তিনি এক চলমান চেতনা। বাঙালির মনন ও সংস্কৃতির প্রাণশক্তি। তিনি এক জীবন্ত মহাকাব্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের পরিধি বিশাল। তিনি কেবল সাহিত্যস্রষ্টা নন, ছিলেন একাধারে গভীর দার্শনিক, চিন্তানায়ক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও চিত্রকর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি যেভাবে একটি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, তা তুলনাহীন। তাঁর রচনা শুধু ভাষার সৌন্দর্য নয়, জীবনের সত্যতার প্রতিফলন।

তরুণ প্রজন্মের কাছেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অপ্রতিরোধ্যভাবে জীবন্ত। আমাদের বিস্মিত করে তাঁর প্রেমের, বিরহের, আত্মার, স্বাধীনতার, প্রকৃতির, ঈশ্বরের, মানুষের সন্ধানে লেখা সেই বিস্ময়কর সৃষ্টিগুলো। রবীন্দ্রসাহিত্য কেবল পড়ার জন্য নয়, তা অনুধাবনের। সে অনুধাবনই তৈরি করে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এক শতাব্দী আগে জন্ম নেওয়া কবির এক গভীর আত্মিক বন্ধন।

আজকের জটিল সময়েও রবীন্দ্রনাথের দর্শন আমাদের জন্য দিশার মতো কাজ করে। বিশ্বায়নের যুগে যেখানে আত্মপরিচয়ের সংকট ক্রমেই বেড়ে চলেছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ আমাদের শেখান, ‘আমি কে’ প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে, বাইরে থেকে নয় বরং অন্তর থেকে। নারী চরিত্র, স্বাধীনচেতা মানুষ, ধর্মীয় সহনশীলতা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, আত্মোপলব্ধির আকাঙ্ক্ষা—সবই তাঁর সাহিত্যে এমনভাবে মিশে আছে, যা আমাদের ভাবায়, আন্দোলিত করে। তাঁর মতো করে কে লিখতে পেরেছেন ‘চোখের জলে দেখা হয়’; কিংবা কে বলতে পেরেছেন, ‘তোমার হল শুরু, আমার হল সারা?’

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা নিয়ে যে চিন্তা রেখেছিলেন, তা আজকের সময়েও প্রাসঙ্গিক। তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল শিক্ষা হওয়া উচিত মুক্ত, প্রকৃতিনির্ভর এবং মনুষ্যত্ববোধনির্ভর। বর্তমানের পরীক্ষামুখী শিক্ষাব্যবস্থার ভিড়ে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন এক শান্তিপূর্ণ বিকল্প পথ দেখায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রবীন্দ্রচর্চা অব্যাহত থাকলেও, প্রয়োজন আরও বেশি করে তাঁর চিন্তাকে পাঠ্যক্রমের বাইরেও আমরা তথা তরুণদের জীবনের অংশ করে তোলা। রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন একজন সহচর, যাঁর সঙ্গে হেঁটে যাওয়া যায় জীবনের কঠিনতম পথেও। বাংলার প্রতিটি উৎসবে, অনুষ্ঠানে, এমনকি রাজনৈতিক বক্তব্যেও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির উপস্থিতি অনিবার্য। তাঁর লেখা জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ শুধু একটি গান নয়, এটি আমাদের চেতনার প্রতীক। তিনি ছিলেন শান্তির দূত, মানবতাবাদের বার্তাবাহক। শান্তিনিকেতনের ছায়ায় গড়ে ওঠা তাঁর বিশ্ববোধ আজও বিশ্বসম্প্রীতির বার্তা বহন করে।

আরও পড়ুন

যখন একজন মহান মানুষের চিরপ্রস্থান ঘটে তখন হয়তো তাঁর দেহ আর থাকে না; কিন্তু তাঁর চিন্তা, সৃষ্টি, দর্শন, ভাষা যদি থেকে যায়, তবে তিনি আসলে হারিয়ে যান না চিরতরে। রবীন্দ্রনাথ তেমনই এক অনন্তসত্তা। তাঁর মৃত্যু হয়নি, হয়েছে রূপান্তর। তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন বাতাসে, আলোয়, কাব্যে, গানে, মনের গহিনে। প্রজন্মের তরুণ যখন কোনো প্রিয় মানুষকে হারিয়ে হাহাকার করে, তখন তাঁর পাশে দাঁড়ায় রবীন্দ্রনাথ; ‘যা কিছু প্রিয় করেছ বিদায় জানাও তাকে’। কিংবা যখন স্বপ্ন ভেঙে যায়, তখন বলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’

আমরা স্মরণ করছি এক মহাজীবনের সমাপ্তি, কিন্তু অনুভব করছি তাঁর চিরন্তন সৃষ্টির নবজন্ম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির প্রাণে যেমন স্থায়ী, তেমনি এ প্রজন্মের হৃদয়েও তিনি এক আলোকবর্তিকা। যত দিন প্রেম, প্রকৃতি, প্রতিবাদ, আত্মসন্ধান ও মানবতা থাকবে, তত দিন রবীন্দ্রনাথ অনিবার্য। আমাদের প্রজন্মের শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি নতুন ব্যঞ্জনায়, নতুন ভাষায়, কিন্তু গভীরতর। তিনি যুগস্রষ্টা, তাই কোনো যুগই তাঁকে ছুঁয়ে যেতে পারে না, তিনি ছুঁয়ে যান সব যুগকে।

শিক্ষার্থী, গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত