‘পঞ্চতন্ত্র’ শুধু একটি নীতিকথার বই নয়, এটি মানুষের জীবনচর্যাকে সহজভাবে বোঝানোর এক চিরন্তন পথনির্দেশ।
‘পঞ্চতন্ত্র’ মূলত গল্পে গল্পে জীবনের শিক্ষা দেওয়ার এক অনন্য কীর্তি। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারতের মহিলারোপ্য রাজ্যে অমরশক্তি নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি বিদ্বান ও বিচক্ষণ ছিলেন, কিন্তু তাঁর মনে শান্তি ছিল না। তাঁর তিন ছেলেই অজ্ঞ ও মূর্খ। শাস্ত্রকারেরা বলেন, সন্তানহীন হওয়া বা জন্মেই মৃত্যুবরণ করা সন্তানও তত কষ্ট দেয় না, যতটা দেয় জীবিত অবস্থায় মূর্খ পুত্র।
অমরশক্তি তাঁর ছেলেদের শিক্ষিত করতে আহ্বান করেন পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মাকে। বিষ্ণুশর্মা বুঝেছিলেন, শুধু কঠিন শাস্ত্রপাঠে এদের মন টিকবে না। তাই তিনি লিখলেন পাঁচটি গ্রন্থ—‘মিত্রভেদ’, ‘মিত্রলাভ’, ‘কাকোলূকীয়’, ‘লব্ধপ্রণাশ’ এবং ‘অপরীক্ষিতকারক’। এই পাঁচটি তন্ত্রের সমন্বয়ই হলো ‘পঞ্চতন্ত্র’।
পঞ্চতন্ত্রের কাহিনিগুলো বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। কারণ, এতে পশুপাখিদের চরিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। কাক, শিয়াল, খরগোশ, হরিণ বা সিংহ—এরা সবাই মানুষের চরিত্রকে প্রতিফলিত করে। হাস্যরসের ভেতর দিয়েই গুরুতর উপদেশ দেওয়া হয়। শিয়ালের ধূর্ততা, কাকের বুদ্ধি, হরিণের সরলতা বা সিংহের ক্ষমতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে মানুষের সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি।
এই কাহিনিগুলো শুধু শিশুদের বিনোদন নয়, বরং এক মহাশিক্ষার ভান্ডার। শেখানো হয় কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে আর কার সঙ্গ নয়, কোন দেশে থাকা উচিত আর কোন দেশ ত্যাগ করা ভালো, বিপদে উপস্থিতিই প্রকৃত বন্ধুর প্রমাণ; এবং জীবনে কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ ত্যাগ করলে মানুষ কীভাবে সুখী হতে পারে। সবকিছুই বলা হয় রম্যরসের আড়ালে, যা ছোটদের সহজেই আকৃষ্ট করে এবং বড়দেরও ভাবায়।
পঞ্চতন্ত্রের প্রভাব শুধু ভারতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রথমে এটি অনূদিত হয় অপরীক্ষিতকারকানি পহ্লবী ভাষায়, এরপর আরবিতে কালিলা ও দিমনা নামে, যেখানে করটক ও দমনক নামের দুই শিয়ালের কাহিনি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়। সেখান থেকে ফারসি, তুর্কি, সিরিয়াক, গ্রিক, লাতিন, ফরাসি, জার্মান, ইংরেজিসহ প্রায় সব বড় ভাষায় অনুবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের ফেবল সাহিত্যে যেমন ঈশপের গল্প, তার ওপর পঞ্চতন্ত্রের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও অনুবাদক ড. দুলাল কান্তি ভৌমিক পঞ্চতন্ত্রের বাংলা অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে পৃথিবীর নানা দেশে এই গল্প নতুনভাবে চিত্রায়ণ করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মুমিত আল রশিদ ‘পঞ্চতন্ত্র’কে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। পরে এই অনুবাদের ওপর ভিত্তি করে ইরানে শিশুদের জন্য কার্টুন তৈরি হয়, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হাসতে হাসতে শিশুরা শিখছে সততা, বুদ্ধিমত্তা, বন্ধুত্ব আর নৈতিকতার শিক্ষা।
বাংলাদেশেও যদি এমন কার্টুন সিরিজ তৈরি হয়, তবে শিশুদের মনে নীতিশিক্ষা সহজভাবে গেঁথে যাবে। বিনোদনের সঙ্গে শিক্ষার এমন অপূর্ব সমন্বয় নিঃসন্দেহে শিশুদের মানসিক গঠনকে আরও দৃঢ় করে তুলতে পারে।
‘পঞ্চতন্ত্র’ শুধু একটি নীতিকথার বই নয়, এটি মানুষের জীবনচর্যাকে সহজভাবে বোঝানোর এক চিরন্তন পথনির্দেশ। হাস্যরস, রম্যতা ও কাহিনির টানে মানুষ আজও এটিকে গ্রহণ করে, যা প্রমাণ করে জ্ঞানের এই ভান্ডার কতটা কালোত্তীর্ণ।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়