বাংলা সাহিত্যে দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন সচরাচর খুব বেশি চোখে পড়ে না। কিন্তু লেখক পুলিন বকশীর বই ‘সুফি দর্শন ও প্রেম: রুমি, কিয়ের্কেগার্ড ও নিৎসের বয়ানে’ সেই অভাবকে পূরণ করেছে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। জ্ঞানকোষ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ১৭৪ পৃষ্ঠার এই বই শুধু একটি দর্শনভিত্তিক গ্রন্থ নয়, বরং পাঠকের হৃদয় ও মনের গভীরে আলোড়ন তুলতে সক্ষম এক ব্যতিক্রমী সৃষ্টিকর্ম।
বইটির শুরুতেই লেখক তুলে ধরেছেন ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গ, যা পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী এক মহাযুদ্ধে রূপ নেয়। রাজপথে তরুণদের প্রতিরোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ আর স্বৈরাচারের পতনের কাহিনি এখানে শুধু ইতিহাস হিসেবে আসেনি, এসেছে আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেও। ইতিহাসের নানা স্বৈরশাসকের পতনের সঙ্গে এই সমকালীন ঘটনার মিল টেনে লেখক দেখিয়েছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ আসলে আত্মার স্বাধীনতা অর্জনেরই আরেক রূপ।
রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার ভেতর দিয়েই বইটি প্রবাহিত হয়েছে প্রেমের গভীর দর্শনে। মাওলানা রুমির প্রেমের ব্যাখ্যা, কিয়ের্কেগার্ডের অস্তিত্ববাদী প্রেমচিন্তা কিংবা নিৎসের প্রেম ও মানবজীবন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি—সবকিছুই লেখক এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে পাঠকের কাছে প্রেম কেবল আবেগ নয়, বরং আত্মোন্নয়নের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। ইবনুল আরাবির ‘ইনসানুল কামীল’-এর ধারণাকে ঘিরে আধ্যাত্মিক প্রেমের যে বিশ্লেষণ এসেছে, তা পাঠককে ভিন্ন এক দিগন্তে পৌঁছে দেয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, লেখক শুধু তত্ত্বকথা কিংবা দার্শনিক যুক্তি দেননি, বরং জীবনের ছোট মুহূর্তকে টেনে এনেছেন দর্শনের আলোচনায়। ঢাকার ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে কিংবা এক চায়ের দোকানে বসে পাশের মানুষের গল্প শুনতে তিনি যে উপলব্ধির জন্ম দেন, তা পাঠকের কাছে একান্ত ঘনিষ্ঠ মনে হয়। বাস্তব ও আধ্যাত্মিকতার এমন অনন্য মেলবন্ধনই বইটিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
সর্বোপরি বলা যায়, ‘সুফি দর্শন ও প্রেম’ কেবল প্রেম বা দর্শনের বই নয়, এটি আমাদের সময়, সমাজ ও আত্মার এক সৃজনশীল বিশ্লেষণ। এই গ্রন্থ পাঠককে একদিকে যেমন রাজনৈতিক ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখায়, অন্যদিকে প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার মধ্য দিয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে সহায়তা করে।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা