রাতুল বাসের জানালায় মুখ ঠেকিয়ে দূরের পাহাড়গুলো দেখছিল। ভোরের আলো ফোটামাত্র রাঙামাটির মাটি ছুঁয়েছে। আশপাশের সবাই রাতভর বাসযাত্রায় ক্লান্ত। কিন্তু রাতুলের চোখে ঘুম নেই। নদীবিধৌত এক গ্রাম থেকে আসা ছেলেটি আজ প্রথমবারের মতো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি হওয়া বিশাল কাপ্তাই লেক দেখতে যাচ্ছে। বাড়ির পাশেই পদ্মা নদী, আর নদীর ওপারে চর—যেখানে ধান কাটার গন্ধে, ধুলার মধ্যে, শিশুর কান্নার শব্দে সে বড় হয়েছে।
সঙ্গে আছে কাকলি—প্রশিক্ষণের প্রথম দিন থেকে যার সঙ্গে এক অদৃশ্য সুতোয় মন বাঁধা হয়ে গেছে।
বাংলা একাডেমির ছয় মাস মেয়াদি নবীন লেখক প্রশিক্ষণ কর্মশালাটি শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাই প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে একটি সাহিত্যভ্রমণের আয়োজন করা হয়। কুড়িজন প্রশিক্ষণার্থী। সবারই চোখে স্বপ্ন—একদিন বড় লেখক হবে। স্বপ্নের তালিকার ওপরের দিকে আছে কাকলি। সে বলে, ‘আমি পাহাড়ের এমন গল্প লিখব, যা পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে।’ কাকলিকে উদ্দেশ করে রাতুল বলে, ‘আমি কাপ্তাই লেকের গল্প লিখব; হাসি-কান্না, দুঃখ-সুখের ছোট ছোট গল্প। তোমাকে নিয়েও লিখব, হয়তো কাপ্তাই লেকের মতো কোনো বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে।’
তাদের বন্ধুত্ব, তাদের স্বপ্ন আর এক অদৃশ্য সংকোচে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে নদীর ঢেউয়ের মতো কাছে আসে। আবার অকারণে পিছিয়ে যায়।
এক.
সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে বাস এসে ঢোকে রাঙামাটি শহরে। ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে যায় রাতুলের মুখ। কাকলি চোখ মুছতে মুছতে জানালার ফাঁক দিয়ে পাহাড় দেখে হেসে বলে, ‘রাতুল দেখো, যেন কেউ সবুজ দিয়ে পাহাড় সাজিয়ে রেখেছে।’
রাতুল মাথা নাড়ে। তার কাছে মনে হয়, ডুবন্ত বন, ডুবে যাওয়া গাছ, ভাসমান পাহাড়—সব মিলিয়ে যেন এক অসমাপ্ত কবিতা।
তারা বাস থেকে নেমেই বোটে এসে বসল। নীল-সবুজ পানির ওপর দুলছিল বোট। রোদ তখন ঝলমল করছে। একটু পরে নাশতা শুরু হতেই বোট চলা শুরু করল। পাহাড়, জল, আকাশের ত্রিভুজ রেখায় দাঁড়িয়ে রাতুলের মনে হচ্ছিল, সে এক অন্য জগতে এসে পড়েছে।
কাকলিও মুগ্ধ। কিন্তু তার চোখে মুগ্ধতার পাশাপাশি একটা গভীর প্রশ্নের ছায়া উঁকি দেয়। অদ্ভুত সুন্দর। কিন্তু এই সৌন্দর্যের পেছনে কত কষ্ট লুকিয়ে আছে, ইতিহাসই তা ভালো জানে।
দুই.
সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সেদিন বোটে উঠেছিলেন চাকমা সম্প্রদায়ের একজন নামকরা নাট্যকার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক মৃত্তিকা চাকমা। তাঁর আলোচনায় লেকের আনন্দ ইতিহাসের এক বেদনায় রূপ নিল। তিনি বললেন, ‘এই লেক কেবল পানি নয়; এখানে আছে পাহাড়িদের উচ্ছেদ, ডুবে যাওয়া গ্রাম, হারানো স্মৃতি।’
তাঁর কথা শুনে কাকলি স্থির হয়ে গেল। রাতুল জলরাশির দিকে তাকিয়ে শুনল, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ—চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সবাই চেয়েছিল তারা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হোক। তখনকার চাকমা রাজাও এটাই চেয়েছিলেন। কারণ, তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস—সবকিছুই ছিল সমতলের বাঙালিদের থেকে আলাদা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নথিতে কেবল ‘চট্টগ্রাম’ লেখা হওয়াতে পুরো এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
এরপরের ঘটনা আরও হৃদয়বিদারক। পাকিস্তান সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে পঞ্চাশের দশকে কাপ্তাইয়ে বাঁধ নির্মাণ করে। গড়ে ওঠে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম লেক। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় পাহাড়ি জনপদে। ২০ হাজারের মতো পরিবারের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ হারায় তাদের ঘরবাড়ি, প্রায় ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি প্লাবিত হয়, ডুবে যায় চাকমা রাজার প্রাসাদ, ডুবে যায় প্রাচীন গ্রাম, বৌদ্ধবিহার, সমাধিসৌধ ইত্যাদি। যে পানির সৌন্দর্যে আজ সবাই মুগ্ধ, সেই পানি কারও কারও শতাব্দীপ্রাচীন স্মৃতি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
এসব শুনে রাতুল নীরব হয়ে গেল। কাকলি বলল, ‘আমরা কি সৌন্দর্য দেখতে এসেছি নাকি বেদনা?’
রাতুল উত্তর খুঁজে পায় না।
পাহাড়ি-বাঙালি একই সঙ্গে পাকিস্তানবিরোধী লড়াই করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরও ভুল বোঝাবুঝির কারণে আস্থাহীনতা কমল না। কাকলি লেখকের দিকে তাকায়, ‘তাহলে সম্পর্কটা ভেঙে গেল?’
তিনি বলেন, ‘ভাঙন শুরু হয়েছিল আরও আগেই। কিন্তু গভীর হয়েছে পরে।’
বোটের সবাই তখন থমকে যায়। নাট্যকার বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপরই তখনকার সরকারপ্রধান রাঙামাটিতে এসে এক জনসভায় বলেছিলেন, “জাতি হিসেবে তোমাদের এখন থেকে বাঙালিতে উন্নীত করা হলো।” তিনি চেয়েছিলেন সবাই মিলেমিশে এক জাতি হোক। কিন্তু পাহাড়িদের অনেকেই এটাকে তাদের পরিচয়ের ওপর চপেটাঘাত মনে করেছিল।’
এরপরের ইতিহাস আরও করুণ। একটা সময়ে সমতলের হাজারো বাঙালি পরিবারকে পাহাড়ে পুনর্বাসন করা হলো। এতে জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব গেল বেড়ে।
এই সব ইতিহাস যেন বাতাসে ঝুলে থাকে, লেকের পানিতে ঢেউ তোলে। রাতুলের মনে হয়, এই নীল জলরাশি আসলে নীরব কান্না বহন করে চলেছে।
তিন.
ইতিহাসের ভারী আলোচনা শেষে সবাই নীরব। কিন্তু প্রকৃতি তাদের নিজের মতো করে টেনে নিয়ে যায়। লেকের দিগন্তে দেখা যায় সোনালি সূর্য, জলের ওপর ভেসে বেড়ানো সাদা পাখির ঝাঁক, জলের নাচন।
পড়ন্ত দুপুরে তারা লেকের পানিতে গোসল করে। প্রশিক্ষণার্থীরা জলে নেমে মেতে উঠল। কাকলির হাসি দেখে রাতুল নিজের বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত টান অনুভব করল।
পানির ভেতর কাকলি বলল, ‘তুমি কি কখনো এভাবে এত বড় জলরাশির মধ্যে নেমেছ?’
রাতুল মাথা নাড়ল, ‘না। আমার নদী অনেক ছোট। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমি লেখালেখির এক বিশাল জগতে পা দিলাম।’
কাকলি হেসে বলল, ‘তুমি পারবে রাতুল। শুধু গ্রামের গল্প নয়, তোমার লেখায় মানুষের হৃদয় থাকবে।’
সেই রাতে বোটের ছাদে তারা পাশাপাশি বসে অনেক গল্প করল। শৈশবের গল্প, প্রথম লেখা, অপ্রকাশিত কবিতা, প্রথম প্রেম, স্বপ্ন, ভয় ইত্যাদি।
হঠাৎ কাকলি বলল, ‘রাতুল, মনে হয় আমরা দুজন একই গল্পের চরিত্র।’
রাতুল তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে, হয়তো চূড়ান্ত পরিণতিটাও আমাদের হাতে।
তাদের কথার ভেতর দিয়ে যেন পাহাড়ি বাতাস নরম হয়ে আসে।
চার.
পরদিন তারা স্থানীয় বাজারে নামল। পাশে ছিল পাহাড়ি পল্লি—চাকমাদের ঘর, রঙিন জীবন। সেখানে এক দোকানদার তাদের শোনাল বহু বছরের পুরোনো এক কাহিনি—এক মার্কিন পর্যটক দম্পতির ট্র্যাজেডির গল্প। সুদূর মার্কিন মুলুক থেকে এক পর্যটক দম্পতি এসেছিল কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। বোটে ভেসে ভেসে তারা লেক দেখছিল। এভাবে দুই দিন কেটে যায়। তৃতীয় দিন বিকেলে তারা যখন ঘুরছিল, হঠাৎ ঝড় ওঠে। ঝোড়ো বাতাসে বড় বড় ঢেউ লেকে আছড়ে পড়ে। বোট ভীষণভাবে দুলতে থাকে। তারা খুব ভয় পায়। একপর্যায়ে নারী পর্যটক ভয় পেয়ে লেকের জলে ঝাঁপ দেয়। তাকে বাঁচাতে পুরুষ পর্যটকও ঝাঁপ দেয়। মুহূর্তের ভেতর তারা নিখোঁজ হয়ে যায়। তাদের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে দুই দিন পর তাদের লাশ পাওয়া যায়। দেখা যায়, লাশ দুটি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। এই ঘটনা ওই সময়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
গল্প শুনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। কাকলি ফিসফিস করে বলে, ‘যদি এভাবে কেউ আমাকে বাঁচাতে নামে তাহলে আমিও ঝাঁপ দিতে পারি।’
রাতুল মুচকি হেসে বলে, ‘তাহলে আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে তোমাকে তুলে আনব।’
কাকলি চোখ মেলে তাকাল—কথাটা মনে রেখো।
তাদের নীরবতা তখন জলের মতো গভীর হয়ে যায়।
পাঁচ.
তৃতীয় দিন দুপুরে পাহাড়ের এক ঢালে তারা হাঁটছিল। সবুজ পাতার ভেতরে কিছু নীল বুনোফুল বাতাসে দুলছিল। রাতুল একটি ফুল তুলে কাকলির খোঁপায় গুঁজে দিল। কাকলি চোখ বন্ধ করে সেই মুহূর্তটাকে মনে গেঁথে নেয়। তারপর বলে, ‘রাতুল, তোমার এই ফুলটা আমার জীবনে পাওয়া সেরা উপহার।’
রাতুল লজ্জায় মাথা চুলকায়। বলে, ‘আমি চাই তোমার গল্পের প্রথম নায়কও আমি হই।’
কাকলি হেসে বলল, ‘তুমি তো আছ-ই।’
সেই মুহূর্তে লেকের নীল পানি যেন হালকা বাতাস হয়ে দুজনকে এক অদৃশ্য বাঁধনে বেঁধে দিল।
ছয়.
ভ্রমণের শেষ দিন আলোচনায় উঠে এল স্বাধীনতার পরের সময়গুলোর কথা।
শান্তি আলোচনার বহু পথ গেছে। লড়াই হয়েছে, ভুল হয়েছে, দোষ–দায় দুই পক্ষেরই আছে। পাহাড়িরা চেয়েছিল তাদের পরিচয় রক্ষা করতে আর বাঙালিরা চেয়েছিল নিরাপদ জীবন পেতে।
এরপর ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির কথা এল। সাফল্য, ব্যর্থতা, অস্থিরতা—সবই এক এক করে আলোচনা হলো। রাতুল বলল, ‘একদিন নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আলোচক হেসে উত্তর দিল, ‘হবে, যদি মানুষ মানুষকে সম্মান দিতে শেখে।’
কাকলি নীরবে শুনছিল। বলল, ‘আমি চাই এই লেকের গল্পের সঙ্গে মানুষের মিলনের গল্পও লিখতে।’
রাতুল তখন বুঝতে পারে, কাকলি শুধু লেখক নয়, সে যেন পাহাড়ি ভূমিতে শান্তির স্বপ্নদ্রষ্টা।
সাত.
ভ্রমণ শেষ। বোট ঘাটে ভিড়ল। পাহাড়ের বাতাস তখন বিদায়ের মতো ভারী।
রাঙামাটি শহর ছেড়ে ঢাকায় ফিরতে হবে, তারপর রাতুল যাবে বগুড়ায়, কাকলি পঞ্চগড়ে।
দুজনেই তা জানে, তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন ঘনিয়ে আসছে।
বাসে ওঠার আগে কাকলি বলে, ‘দেখো রাতুল, জীবন কত অদ্ভুত! ছয় মাসেই মানুষ কতটা বদলে যায়।’ রাতুল নরম গলায় বলে, ‘বদলে যাই বলেই তো লিখতে পারি। অনুভূতিগুলো থেকে যায়।’
তারা অঙ্গীকার করল, ‘প্রতি মাসে একবার দেখা করবে, লেখালেখি চালিয়ে যাবে,
একদিন একে অপরকে গল্পের ভেতর দিয়ে জয় করে নেবে।’
রাতুল বলল, ‘কাপ্তাই লেকের যে ফুলটা আমি তোমাকে দিয়েছি, ওটা যেন শুকিয়ে না যায়।’
কাকলির চোখে জল টলমল করে ওঠে। ফুল শুকালেও গল্প শুকাবে না।
বাস ছাড়লে কাকলির হাত ছুঁয়ে রাতুল বলে, ‘তুমি যেখানেই থাকো, লেকের ওই নীল রং তোমার চোখে লেগে থাকুক।’
কাকলি মাথা নাড়ে, ‘আর তোমার লেখায় থাকুক আমার হাসি।’
বাস ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়। লেকের পানি নীল থেকে ধূসর হয়। পাহাড় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। আর সেই নীরবতার মধ্যে রাতুল বোঝে, এই ভ্রমণ শুধু একটি সফর নয়, তার জীবনের সেরা গল্পের প্রথম অধ্যায়।