বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করি। মাথায় শুধু ঘুরছিল, ফিরে এসেই প্রমোশন লেটারে সাইন করব।
রাজবাড়ী স্টেশন যখন পৌঁছালাম, তখন রাত পৌনে দুইটা। স্টেশনে প্রবেশ করতেই ধাক্কা খেলাম, জনমানবশূন্য একটা স্টেশন। চারদিকে ঘন কুয়াশা, ল্যাম্পপোস্টের মিটমিট আলোয় অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করেছে। অফিস থেকে জিওলজিক্যাল সার্ভে ডিপার্টমেন্টের গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি। সফলভাবে তথ্য নিতে পারলে প্রমোশন হবে, মেসের কষ্টকর জীবন কাটিয়ে একটা নতুন বাসা নিতে পারব। বিয়ে করতে পারব অরিত্রিকে। তাই জিনিসপত্র নিয়ে চলে এলাম এই গ্রামে।
খোঁজখবর নিয়ে জানলাম এখানে ট্রান্সমিশন পাওয়ার জেনারেটর স্টেশন বসানো হয়েছে। আমার দায়িত্ব সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে বাতাস ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা। আগের দিন রাতে ম্যানেজার স্যার ফোন করে বললেন,
- বুঝলেন কবির সাহেব, আপনি কিন্তু স্টেশনে কোনো প্রকার ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবেন না। প্রকল্পটি অনেক স্পর্শকাতর। আমরা কোনো প্রকার ঝুঁকি নিতে চাই না।
- ঠিক আছে স্যার।
- এমনকি কোনো প্রকার কাগজও ব্যবহার করবেন না। মুখে মুখে তথ্য নিয়ে চলে আসবেন দ্রুত। তারপর প্রমোশন লেটারে সাইন করবেন।
বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করি। মাথায় শুধু ঘুরছিল, ফিরে এসেই প্রমোশন লেটারে সাইন করব।
স্টেশনে নামার পর কোনো কিছুই স্বাভাবিক লাগছে না। গুমোট বাতাসে সবকিছু যেন আটকে আছে। কোনো যানবাহন নেই, অগত্যা হেঁটেই রওনা দিলাম। আমাকে পথ দেখাচ্ছে গুগল ম্যাপ। কিছুক্ষণ পর স্ক্রিনটা কয়েকবার বিপ করে নেটওয়ার্ক চলে গেল। হঠাৎ যেন গোলকধাঁধায় পড়ে গেলাম। বুঝতে পারছি না কোন দিকে যাব। দাঁড়িয়ে আছি গ্রামের মেঠোপথের মাঝখানে, চারপাশে উঁচু উঁচু তালগাছ, একপাশে নদী, অপরপাশে বিস্তীর্ণ মাঠ। দ্বিতীয় ধাক্কা খেলাম গাছের পাতার রং নীল দেখার পর। বুঝতে পারলাম এখানে কোনো একটা সমস্যা আছে। এর শেষটা দেখব, কাজটা আমাকে করতে হবে। মনকে ভরসা দিলাম।
হঠাৎ মাথার ভেতর তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করলাম। দুই কান বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে। ‘কবির কোথায় যাচ্ছিস?’ ঘুরে দেখি নিবিড় দাঁড়িয়ে, ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ওকে কিছুটা এলোমেলো দেখাচ্ছে।
নিবিড় আমার শৈশবের বন্ধু। হঠাৎ ওর উপস্থিতি আমাকে যেন অথই সাগরে কিনারা এনে দিল। তাঁর হাত ধরতেই অনুভব করলাম অসম্ভব ঠান্ডা একটা হাতে যেন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পন্দন ছড়াচ্ছে। আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। পথ হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, ‘গ্রামটা অনেক বদলে গেছে, স্বাভাবিক নয় কিছু।’
‘মানে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে জানাল, ছয় মাস আগে কিছু বিজ্ঞানী এসে এখানে ভূগর্ভস্থ একধরনের ম্যাগনেটিক ফোর্স খুঁজে পায়। তারপর শুরু করে এক্সপেরিমেন্ট। তাঁরা চেয়েছিল পৃথিবীর প্রাকৃতিক শক্তির বিকল্প উৎস তৈরি করতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়।’
‘তারপর?’
‘ওই শক্তি, মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক নতুন রূপ, সব মানুষ একেকটা ডেটা সার্ভার হয়ে গেছে। সবাই আর মানুষ নেই, কবির। জিও-এক্স ৭–এর প্রকল্প হয়ে গেছে।
‘তুই এত তথ্য পেলি কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
নিবিড় অদ্ভুতভাবে হাসল। আমার মাথা ঘুরতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম, সত্যিই ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। চারদিক থেকে কানে ভেসে আসছে হাসি কান্না, চিৎকারের শব্দ। হঠাৎ নিবিড় শীতল হাতে আমাকে টেনে ধরল—
‘আর যাবি না। আর এক পা এগোলেই ম্যাগনেটিক ফোর্স তোকে স্পর্শ করবে। তোর মস্তিষ্কের নিউরাল প্যাটার্ন এখানেই আটকে যাবে। সঙ্গে তুইও।’
‘কিন্তু আমাকে তো কাজটি শেষ করতে হবে। অফিশিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট।’
নিবিড় অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাত ধরল। মনে হলো আমাকে কেউ সজোরে টান দিল। মস্তিষ্কে অদ্ভুত যন্ত্রণা, কানে একটানা শব্দ। নিজেকে আবিষ্কার করলাম স্টেশনের সামনে। নিস্তব্ধ রাস্তায় নীরবতা ভাঙাল মোবাইলের রিংটোন। স্ক্রিনে রাহাতের নাম। রিসিভ করতেই সে বলল—
‘কবির তুই কোথায়? নিবিড় ঘণ্টাখানেক আগে বাইক এক্সিডেন্ট করেছে। স্পট ডেড।’
‘কী বলিস? নিবিড় তো আমার সঙ্গেই ছিল।’
আমার পাশে নিবিড়কে আর খুঁজে পেলাম না। ধীরে ধীরে পেছনে তাকালাম, কিছুই নেই। শুধুই নীরবতা আর কুয়াশায় মোড়ানো অন্ধকার।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা