চিঠি
বাসুন বারোতে (এগারোতম পর্ব)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।
বাসুন,
আজকে বলব দুপুরের গল্প।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই সেলফোন বেজে ওঠে। কলার আইডি দেখে কনফার্ম হই এটা দোভাষীর অফিস থেকে কল। ফোন তুলে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্তে সিলেটি মহিলা বেগমের গলা ভেসে আসে, ফোনের অন্য লাইনে আছেন টরন্টো লিগ্যাল এইড অফিসের সারাহ। কথা বলছি বেগমের কেস নিয়ে। বেগম সিলেটি মহিলা। সম্প্রতি যক্ষ্মা হয়েছে। রোগ এখন কোন পর্যায়ে, তা ফোনের ভেতর দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। আবার যেহেতু দোভাষীর কাজ করছি, তাই কোনো পক্ষকেই বাড়তি প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। কথা চলছে থ্রি ওয়ে লাইনে। আমি একই সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করছি বেগমের আসল সমস্যা কোথায়।
জানা গেল, বেগম অনেক দিন ধরে সরকারি সাহায্য পেয়ে আসছেন। এই দেশে যাকে বলে সোশ্যাল। এটা নতুন কিছু নয়। তাহলে আর কী চান বেগম? ইতিমধ্যে সারাহ প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, ‘বুঝতে পারছি না, সোশ্যালের ভেতরে লিগ্যাল এইড কেন।’ জানতে পারলাম, বেগমকে টরন্টো পাবলিক হেলথ ভালো ও পুষ্টিকর খাবার খেতে বলেছে। কারণ, যক্ষ্মার প্রাথমিক স্টেজে দ্রুত ওজন কমতে থাকে। কানাডায় প্রতিটি সেক্টর আলাদাভাবে কাজ করে। তাই পাবলিক হেলথ শুধু ভালো খাবারের পরামর্শই দেবে; কিন্তু বেগমকে খাবার কিনে খেতে হবে সোশ্যালের টাকায়। যা ভালো খাবার কেনার জন্য কুলায় না। না কুলানোই স্বাভাবিক। এবার জানা গেল, বেগম এ কারণেই তাঁর সোশ্যাল অফিসে বাড়তি ডলারের জন্য আবেদন করেছেন। এই আবেদন নাকচ হয়েছে বলেই এখানে লিগ্যাল এইড জড়িত হয়েছে।
এতক্ষণ কথা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি, বেগম ও সারাহ একই অফিসে বসে আছেন। আমি ফোনে বেগমকে সহযোগিতা করছি। এবার বেগমকে সারাহ বলছেন, সরকারি সাহায্য হিসেবে যে ভাতা দেওয়া হয়, সেখানে বেশ কিছু নিয়ম আছে। চাইলেই যেকোনো দাবি করা যায় না বা পাওয়া সম্ভব নয়। বেগমের যক্ষ্মা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই সরকার তাকে বাড়তি অনুদান দেবে না। কিন্তু বেগম এই বাড়তি ডলারের জন্য আবেদন করেছেন। সরকারের কাছ থেকে আপিলের উত্তর পেতে দুই বছর লেগে যাবে। আবার সেই উত্তর নেগেটিভ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই বেগম যেন কমিউনিটির ফ্রি খাবার ব্যাংকে যোগাযোগ করেন।
আমি জানি না বেগম কত দিন এই দেশে আছেন। তিনি ক্যাশে কোনো কাজ করেন কি না বা তাঁর পরিবারের আর কে কে এই দেশে আছেন; যা দিয়ে বেগমের বাড়তি ডলারের জোগান হতে পারে।
এবার কথা অন্যদিকে চলে গেল। বেগম এখন প্রশ্ন করছেন, তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে দেশে যাবেন, তাঁর জন্য নাকি মা–বাবা লন্ডন বা বাংলাদেশে ছেলে দেখছেন। যদি বিয়ে করতে যেতে হয় তাহলে তাঁর সরকারি সাহায্যের কী হবে?
আমি ভেতরে ভেতরে একই সঙ্গে অবাক ও বিরক্ত হতে শুরু করেছি। এই ঘটনাগুলো আমার কাছে বা যাঁরা এই সেক্টরে কাজ করেন, তাঁদের কছে খুব কমন। কিন্তু বিষয়গুলো যেহেতু মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাই কথা বললে কানাডায় একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষকে খেপিয়ে তোলা হয়। কানাডায় যেহেতু যেকোনো কাজ পাওয়াটাই কঠিন; তাই সরকারি সাহায্যকে অনেকে মনে করেন অধিকার। এবং কয়েক বছর পর এই ফ্রি ডলারের ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যে তখন তাঁর বিবেক বলে আর কিছু কাজ করে না (দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া)।
কানাডায় একটা বিশাল সংখ্যার মানুষ সোশ্যালে থাকে। এর সোজা অর্থ, আমি কানাডায় থাকি, কিন্তু কোনো কাজ পাচ্ছি না। তাই সরকারের দায়িত্ব আমার ভরণপোষণ দেওয়া। যত দিন কাজ না পাচ্ছি তত দিন সরকার আমাকে সহযোগিতা করতে বাধ্য।
কথাটা এখানে শেষ হলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু আসলে কথাটা এখানে শুরু। এই দেশে এ ধরনের সরকারি সাহায্য যাঁরা গ্রহণ করেন তাঁরা জানেন, কী করে তাঁদের জীবনকে পদে পদে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। আর করাটাই খুব স্বাভাবিক। সোশ্যালে থাকা মানুষের অনেকগুলো শর্তের ভেতরে একটি হচ্ছে—তাঁরা নিজ পরিবাবের কাউকে স্পন্সর করতে পারবেন না একটা সময়সীমা পর্যন্ত। কারণ, একটা নির্দিষ্ট রোজগার না থাকলে সরকার পরিবারের কাউকে আনতে দেবে না। সে কারণেই সারাহ বারবার বলছেন, বেগম যেন তাঁর সোশ্যাল অফিসে কথা বলেই যেকোনো পরিকল্পনা করেন।
দোভাষীর কাজ প্রায় শেষের দিকে।
ভাবছি, আমরা বাঙালি জাতি আর কত দিন এই চর্চা করব? সোশ্যালে থেকে সরকারি সুবিধা নেব আবার ক্যাশে ডলার কামাই করে দেশে গিয়ে বড় বড় গল্প দেব। দেশে বাড়িঘর বানিয়ে এমন ভাব করব যে আমি রাজার মতো কানাডায় থাকি। কারণ, এই দেশে দেখাতে পারব না যে আমি রোজগার করি। সেটা দেখালে আমার সোশ্যালের ডলার বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের মানুষ জানবে যে মাসে ক্যাশ ডলার দেশে দিচ্ছি; কিন্তু তারা জানে না যে আমি জেনেশুনে কানাডার সিস্টেম ভঙ্গ করছি। তারা জানছে না যে আমি অসুস্থ না হয়েও অসুস্থতার ভান করে বছর বছর অসুস্থতা ভাতা নিচ্ছি সরকার থেকে। আবার এই আমি সোশ্যাল অফিসে মিথ্যা কথা বলে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে অহংকার করে বলছি, কানাডায় থাকি, অনেক ভালো থাকি। নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্য দেশে গিয়ে দেদার ডলার খরচ করছি। কারণ, কানাডায় আমাকে গরিব থাকার ভান ধরতে হয়।
কত দিন আর এই মিথ্যাচার করব আমরা?
আমার বন্ধু শীরিনা একবার বলেছিল, ‘মানুষ সেই জিনিস, যে চর্চা করতে করতে সৎ এবং অসৎ হতে পারে; আবার দিনের পর দিন মানসিক ডাক্তারের কাছে মিথ্যা কথা বলতে বলতে একদিন সত্যিকার মানসিক রোগী হয়ে ওঠে।’ গত সাত বছরের কানাডায় থাকার অভিজ্ঞতা অনেক। বেগম, যিনি সোশ্যালে থাকার পরও সামান্য বিবেকবোধ দিয়ে কথা বলেন না; আবার অসুস্থতা ভাতায় থাকা শফিউল, যিনি বাংলাদেশে গিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে কানাডা নিয়ে কথা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না; আবার মিথ্যা কাগজ দেখিয়ে ১২-১৩ বছর ধরে সরকারি বাড়িতে থেকে রহমান ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনেন বীরদর্পে। সেখানে আমার মতো সামান্য আড়াই হাজার ডলারের বেতনে কাজ করা মানুষ, যার গাড়ি-বাড়ি নেই; সে যে টিকে থাকে, সেটাই তো বড় বিষয়। অনেকের মতে, তাই সত্য কথা হলেও সব সত্য নাকি বলা যাবে না।
বাসুন, টরন্টো শহর থেকে এখন আমরা অনেক দূরে থাকি। আগে আমার পায়ে পায়ে বাঙালি মানুষকে দেখতে পেতাম, সারাক্ষণ নানা মানুষের নানা রকম অসম আচরণ। কথার সঙ্গে কাজে মিল না থাকা মানুষকে দেখে দেখে হাঁপিয়ে উঠতাম। মনে হতো, করুক মানুষ যা ইচ্ছে তাই, আমি আমার মতো নীরবে বাঁচতে চাই।
তিন মাস হলো তোকে নিয়ে দূরে আছি। কিন্তু মুক্তি কি মিলেছে?
গতকাল বেগমের অ্যাসাইনমেন্টে কথা বলতে হলো পাক্কা দুই ঘণ্টা। এটা জীবিকা বাবু। কিন্তু মানুষ কি কেবলই জীবিকা করে, নাকি তার বোধ দিয়েও সে তাড়িত হয়?
ভাবছি, বেগমরা আর কত দিন পরনির্ভর হয়ে বাঁচবে?
আদর বাসুন
তোর মা
৯ জুন ২০১২
ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা