করোটির কথামালা (পর্ব এক)

টরন্টো এয়ারপোর্টফাইল ছবি

নাহার আপা যখন পাশের চেয়ারে এসে বসলেন, তখনো আমার মুখে চিকেন সমুচা। সকালে ভারী নাশতা করেছিলাম বলেই তিনটার দিকে মনে হলো, একটু কি ক্ষুধা ক্ষুধা লাগছে? কফির জন্য টিম হরটনের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখি একটা সমুচার দোকান। ভাজাপোড়া খেতে মন কেমন করে উঠল। গিয়ে ১০টা সমুচা নিয়ে এলাম। চিকেন আর সবজি–সমুচা।

এই টরন্টো শহরে ডানডাস আর পার্লামেন্ট এলাকায় বেশ কিছু বাঙালি পরিবার থাকে। এসব পরিবারের একটা বড় অংশ অন্তত ২৫-৩০ বছর আগে টরন্টোয় এসেছে এবং অনেকেই সরকারি বাসায় থাকেন। এসব পরিবারের অনেকেই হয়তো তাঁদের যৌবনে সরকারি বাসা পেয়ে গেছেন, অনেকেই ক্যাশে বা কোনোভাবে জীবন নির্বাহ করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ের পরে এসে পড়তি বয়সে তাঁরা সরকারি চিকিৎসাসেবা এবং বয়স্কদের জন্য ওষুধ ভাতার আওতায় আছেন।

সে সময় একটা অনুভূতি হতো, বারবার মনে হতো, বুকের ভেতর থেকে যেন সবকিছু শূন্য হয়ে আছে। কী করব এই বরফের শহরে?

২০০৮ সালের দিকে প্রথম এই অঞ্চলে দোভাষীর কাজ নিতে শুরু করি। যদিও পার্টটাইম কাজ, তবু এই ৯ বছরে আজকের এই কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে অন্তত ২৫ বার এসেছি বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। এর মধ্যে ২০ বার কাজ ছিল বয়স্ক সিলেটি পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে ডক্টর অ্যাপয়েন্টমেন্টে।

হেলথ সেন্টারে বসে আছেন নাহার আপা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তিনি বাংলাদেশি। আগাগোড়া বোরকা দিয়ে ঢাকা বয়স্ক মহিলা। বাংলাদেশের কোন এলাকার মানুষ, জানব কী করে! তাই নাহার আপার দিকে মন না দিয়ে আশপাশের এলাকাটা দেখছিলাম। যদিও এখানে আগেই অনেকবার এসেছি, তবু খুঁটিয়ে কি আর দেখা হয়? দেখি একটা ওয়েটিং রুমের মতো জায়গায় একটা কর্নারে লেখা, ‘এই এরিয়া উৎসর্গ করা হয়েছে “সিনথিয়া বারাক”-এর নামে, যিনি এই এলাকায় ৩০ বছর একজন সেবাদায়ী নার্স হিসেবে বিশেষ অবদান রেখেছেন।’

সিনথিয়া বারাককে নিয়ে একটা লেখাও পড়ছিলাম। মনে পড়ে গেল ছোট বোন কনার মুখ। ২০০৪ সালের এক ভয়ংকর বরফে যখন চার বছরের নাইয়াকে নিয়ে কনার বাসায় এলাম, তখন সামনে শুধু চাপ–চাপ বরফ। সে সময় একটা অনুভূতি হতো, বারবার মনে হতো, বুকের ভেতর থেকে যেন সবকিছু শূন্য হয়ে আছে। কী করব এই বরফের শহরে?

সেই ভয়ংকর দিনে কনা বলেছিল, ‘মেজপা, এই শহরে পড়াশোনা ছাড়া কোনো পথ নেই। তুই যদি মনে করিস, কানাডায় বাকি জীবন থাকবি, তাহলে চোখ বন্ধ করে নার্সিং পড়; কোনো দিন চাকরি নিয়ে ভাবতে হবে না। আর যদি মনে করিস যে এখানে থাকবি না, পাসপোর্ট নিয়ে চলে যাবি; তাহলে নিজের লাইনে একটা লং ডিপ্লোমা করে নে। যেন দেশে ফেরার সময় কিছু একটা হাতে নিয়ে যেতে পারিস।’

এ প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছা করে, টরন্টো শহরের বন্ধু জিনাত নার্সিং পড়া শুরু করে এই শহরের আসার মাত্র আট বছর পরে। তত দিনে সে অন্য লাইনে একটা লং ডিপ্লোমা করে ফেলেছিল। দুই সন্তানের মা। একবার দেশেও ফিরে গিয়েছিল, কানাডায় আর কোনো দিন ফিরবে না, এই পরিকল্পনা নিয়ে।

কিন্তু সেখানেও একই কাহিনি। মাত্র এক বছরের মাথায় দেশ থেকে ফিরে আসে জিনাত। এর প্রায় তিন বছর পর নার্সিং পড়া শুরু করে। তবু কি সহজেই পারে? জিনাতকে শুরু করতে হয়েছিল নবম শ্রেণি থেকে। কারণ, সে আগাগোড়া আর্টসের ছাত্রী। নার্সিং পড়তে হলে ওকে শুরু করতে হবে স্কুল থেকে।

আজ সিনথিয়া বারাকের কথা পড়তে গিয়ে বিলু আর জিনাতের মুখ ভেসে ওঠে। ছোট বোন কনার কথাও মনে পড়ে।

আসলে একমাত্র মানুষই বুঝি সব পারে! একমাত্র মানুষের জীবনেই যুক্ত হয় অসম্ভবকে সম্ভব করে দেওয়ার জয়মাল্য। জিনাতের কথা বলতে গিয়ে সব সময় বলি, চেষ্টা করলে কী না হয়! জিনাত এখন এই শহরে কমিউনিটি নার্স। গাড়ি দাবড়ে কত বিচিত্র মানুষের সেবায় নিজেকে যুক্ত রেখেছে সে।

একই কাহিনি বন্ধু বিলুর। ১৫ বছর বাংলাদেশে সরকারি কলেজে পড়াল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এই শহরে যখন তিন সন্তান নিয়ে, প্রায় ১৭ বছরের সংসার ফেলে, বাংলাদেশের জেলা শহরের বিখ্যাত চিকিৎসক স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বিলু এল, তখন অনেকেই হা হা করে উঠেছিল। বলেছিল, ‘কী করবেন আপনি এখানে? আপনার স্বামীই–বা কী করবে এই বয়সে? কত দিনে আপনারা জব মার্কেটে ঢুকবেন, বলেন?’

অন্যদিকে, বিলুর ননদ নাকি দেশে থাকতেই বলেছিল, ‘তোমার অনেক সাহস। আমার ভাইয়ের এত প্রসার উপেক্ষা করে তুমি কানাডায় যাওয়ার কথা ভাবো কী করে?’ কিন্তু বিলু অনড়। এই শহরে বিলুর জীবন থেকে চোখের পলকে চার বছর চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা এই শহরে পড়াশোনায় ভীষণ ভালো করছে। বিলু ও তার স্বামী সবাইকে অবাক করে দিয়ে নার্সিং পড়া শেষ করে চাকরি করছে।

আজ সিনথিয়া বারাকের কথা পড়তে গিয়ে বিলু আর জিনাতের মুখ ভেসে ওঠে। ছোট বোন কনার কথাও মনে পড়ে। ২০০৪ সালে নার্সিং পড়িনি। কারণ, সেদিন ১০০ ভাগ জানতাম, আর যা–ই করি, কোনো দিন কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকতে পারব না।

আর আজ? ২০১৭ সালে? ১০০ ভাগ জানি, কোনো দিন কানাডা ছেড়ে যাওয়া হবে না। তাই যেকোনো কাজই ভালোবাসি। কস্টির পেশাগত কাজে যখন বসি, তখন মানুষ দেখি। বিচিত্র সব মানুষ, বানের পানির মতো মানুষের কানাডায় আসার তীব্রতা। সারা পৃথিবীর হাজারো মানুষের একমাত্র লক্ষ্য কানাডা।

আবার যখন সিকিউরিটির কাজের শিফটে বসি, তখনো ভালোবাসি সেই কাজকে। কত দেশের মানুষকে দেখি, কিছু একটা কাজ করে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা। এই শহরে পায়ের নিচে মাটি পেতেই হবে একদিন।

আবার যখন দোভাষীর কাজে যাই, তখন নিজেকে বলি, কত কিছু দেখতে পারছি, কত জীবনের কাছাকাছি আছি, এই আমার দেশের মানুষই কতভাবে বেঁচে আছে এই শহরে; আমি তাঁদের সঙ্গী হয়ে আছি। ভাগ্যকে কী বলে ধন্যবাদ দেব!

‘নাইটিঙ্গেল’ উপাধি পাওয়া সিনথিয়া এসেছে জ্যামাইকা থেকে। আগে ছিল লন্ডনে, শেষে কানাডায়। সিনথিয়া, জিনাত, বিলু, লুনাদের মতো হাজারো অভিবাসী পাওয়া যাবে, যারা ৩০ বছর সুটকেস গুছিয়ে রেখেছে দেশে ফিরবে বলে। কিন্তু জীবনের পাকে পড়ে তারা ফিরতে পারেনি। আর ফেরা হয়নি তাদের। যেমন লাখ লাখ গ্রামের মানুষের আর ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরা হয়নি, ঠিক তেমনি। নাহার আপা কি তাদেরই একজন?

দোভাষীর কাজ শুরু হয়েছে। সিনথিয়া বারাকের জীবনী পড়ার মাঝখানেই ডাক আসে চাইনিজ চিকিৎসক ভিকির কাছ থেকে। যে নাহার আপা এতক্ষণ পাশেই বসে ছিলেন, তিনি অবাক হয়ে ফিরে তাকালেন। আমিই যে তাঁর দোভাষী, সেটা আবার বুঝে নিলেন। আপা ওষুধ খাচ্ছেন গাদা গাদা। সব অসুখ আছে আপার। এমন কোনো অসুখ নেই যা নাহার আপার হয়নি। ৩৫ বছরে ইংরেজি ভাষা রপ্ত হয়নি, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে, এক মেয়ের বিয়েও হয়েছে। আপার সারা মুখে পান, আর একদম সিলেটি উচ্চারণে বাংলা বলছেন।

সিলেটি বুঝে বুঝে ইংরেজি বলতে যদিও বেগ পেতে হচ্ছিল, তবু অন্যমনে ভাবছিলাম আপার জীবনের কথা। কথাও বলছি, আবার মনের গহিনে ভাবছি আপার জীবনের নানা বিষয় নিয়ে। নিশ্চয়ই আপা যখন এসেছিলেন, তখন তাঁর তুখোড় জোয়ান বয়স ছিল। দুই হাতে কাজ করে চার ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন। ভেবে রেখেছিলেন, একদিন বেশ কিছু ডলার গুছিয়ে দেশে চলে যাবেন।

কিন্তু যাপিত জীবন নাহার আপাকে পাকে পাকে বেঁধে ফেলেছে। কারণ, তেরো মন ঘি-ও জোগাড় হয়নি, জীবনের রাধাও নেচে ওঠেনি। মানে সেই ডলারও গোছানো হয়নি, দেশেও ফেরা হয়নি। অনেকের জীবনের মতোই নাহার আপাও এই দোলাচলের জীবনের সঙ্গে দুলে চলেছেন। আমাদের অনেকের জীবনও কি তা–ই?

মাত্র ১৩ বছর আগে, কোনো এক সাধারণ অফিস ডে-তে, ঢাকা শহরের মহাখালী ব্র্যাক অফিসে কথাচ্ছলে প্রিয় আফসান ভাইকে (সাংবাদিক আফসান চৌধুরী) বলেছিলাম, কী করি, আফসান ভাই? সবাই বারবার জানতে চায়, কেন সব ছেড়ে কানাডায় যাচ্ছি? যাওয়া ঠিক হবে কি না? কী উত্তর দিই বলেন তো? আফসান ভাই একটা সরল উত্তর শিখিয়েছিলেন। বললেন, ‘লুনা, তুমি সবাইকে বলবে, যে কারণে আপনি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন, ঠিক একই কারণেই আমি ঢাকা ছেড়ে কানাডায় যাচ্ছি।’ আমি জানতাম না, এই ঘটনার মাত্র দুই বছরের মাথায় আফসান ভাই নিজেও কানাডায় আসবেন এবং দাঁতে কামড় দিয়ে চার বছর থেকে কানাডিয়ান পাসপোর্ট করে তবে দেশে ফিরবেন!

নাহার আপার কাছে কাজ শেষ হয়ে যায়। মাথার করোটিতে এলোমেলো কথামালা ভিড় করে থাকে। অফিস শেষের বিকেলে ভিড় ঠেলে ঠেলে নিজের বাসার পথ ধরি। পথে কত কত সাদা মানুষ, বিদেশি মানুষ, কত অণু-পরমাণুর মতো অনুভূতি জমা হতে থাকে। সেই ছোটবেলায় খুব ইচ্ছে হতো ইংরেজিতে কথা বলব, কী ভীষণ ব্যাকুলতা কাজ করত। কেন এমন করে ব্যাকুল হতো মন?

বাসায় ফিরলে মনে হয়, এ কেমন জীবন বেছে নিলাম! আমারও তো একমাত্র ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, নাইয়ার ১৮ হবে সামনের মাসে। সব ফেলে তো আমিও যেতে পারি সেই শিকড়ে! খামাখা এই যে দোলাচলের অনুভূতি বয়ে বেড়াই, কেন? কী দরকার? যেখানে যাওয়ার জন্য, যেখানে ফেরার জন্য, যাদের আরও একবার দেখব বলে মাত্র ১৩ বছর অপেক্ষা করে আছি; কেন চলে যাই না সেখানে? কেন করোটির ভেতর বাসা বাঁধে সেই পুরোনো অভিমান-অপমান?

ক্রমাগত চোখ ঝাপসা হতে থাকে। কোনো অনুভূতি আর কাজ করে না।… (চলবে)

২৩ অক্টোবর ২০১৭
টরন্টো, কানাডা