যদি ডানা থাকত, উড়ে যেতাম বন্ধুদের কাছে

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

মেঘলা আকাশ, মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস আর হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এক হাতে গরম চায়ের কাপ, অন্য হাতে ফোন নিয়ে ইডেন কলেজের পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে গান শুনছিলাম। তখন বেলা ১১টা।

প্রতিদিনের মতোই সকালে তাড়াহুড়া করে ঘুম থেকে উঠে চিড়া খেয়ে কলেজে এসেছিলাম। বাসা থেকে বের হয়েছিলাম ক্লাস করার উদ্দেশ্যে; কিন্তু এসে আর ক্লাসে মন বসছিল না। নিজেকে একটু সময় দেওয়ার জন্য চলে এলাম প্রকৃতির কোলে—নিঃশব্দ, নির্জন আর আমার মতো একলা।

চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ একটা পোস্ট চোখে পড়ল—‘আজ নাকি বন্ধু দিবস!’ এই দুটো শব্দ বুকের ভেতর যেন ঝাঁপটা দিল। মুহূর্তেই মনের পর্দায় ভেসে উঠল কিছু মুখ, কিছু প্রিয় নাম, কিছু গল্প...হারিয়ে গেলাম কল্পনার রাজ্যে।

কিন্তু এখন? এই শহরের পাঁচ মিনিটের রাস্তা যেন পাঁচ ঘণ্টা লাগে। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত—কেউ পড়াশোনায়, কেউ সংসারে, কেউ বাচ্চা নিয়ে। সবকিছু এখন স্মৃতি।

ভেসে উঠল সেই দিনগুলো—যখন বন্ধু দিবসে সবাই সবাইকে কার্ড বানিয়ে দিতাম, হাতে সুতা বেঁধে দিতাম। সেই সুতা আর কার্ড যত্ন করে রেখে দিতাম বইয়ের পাতার ভাঁজে। যখন ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে স্কুলে যাওয়াটা ছিল একপ্রকার যুদ্ধ, শুধু বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য।

এসব ভাবতে ভাবতেই পাশে একটা শালিক পাখি উড়ে এসে বসল। ওকে দেখে হঠাৎ নিজেই বলে উঠলাম, ‘এই শহরে কেউ কারও কথা শোনে না, সবাই ব্যস্ত। ও পাখি, তুমি শুনবে আমার কথা?’
পাখিটি একটু নড়েচড়ে বসল। যেন সম্মতি জানাল। আমি গালে হাত দিয়ে বললাম, ‘তোর একটা নাম দিই না হয়! তবেই তো তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে।’
পাখিটিও মাথা নেড়ে সায় দিল। অনেক ভাবনার পর নাম রাখলাম ‘শালু’।

জানিস শালু,
আমরা স্কুলে ছিলাম আটজন বান্ধবী—মিতু, সেজু, ইমা, বড় মিতু, ঐশী, ফারজানা ও প্রিয়া। দুই মিতুর একজনকে ডাকতাম বড় মিতু। আর ওরা দুজন একে অন্যকে ডাকত ‘মিতা’ বলে। আমরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম, প্রাইভেট পড়তাম, আড্ডা দিতাম, গান গাইতাম—যেন জীবনটাই ছিল একটা খোলা জানালা।

প্রতিদিন সকালে মুখিয়ে থাকতাম কখন তারা আসবে, কখন গল্প করব। নয়টার প্রাইভেট হলেও ওরা আসত সাড়ে আটটার মধ্যে, শুধু একটু বেশি আড্ডা দেওয়ার জন্য। সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একসঙ্গেই থাকতাম—হাসি, খুনসুটি, ছোটখাটো রাগ–অভিমান, সবকিছু নিয়েই একটুকরা জগৎ।

গণিত স্যারের ক্লাসে জ্যামিতি বক্স কেউ ভুলে গেলে, একেকটা যন্ত্রপাতি একেকজন ভাগ করে নিত। অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত না গেয়ে নিজেদের গল্পে মেতে থাকতাম। পৌরনীতি স্যারের ক্লাসে মিতু আর সেজু দাঁড়িয়ে থাকত। কারণ, ওরা পেছনে বসে গল্প করত। স্যার বলতেন, ‘মিতু আর সেজু, দাঁড়ান। কী নিয়ে গল্প করেন? আমাদেরও বলেন, আমরাও শুনি।’ ক্লাসজুড়ে হাসির রোল পড়ে যেত।

ঐশী ছিল সবচেয়ে চুপচাপ। মাঝেমধ্যে এমন কিছু বলত যে আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। প্রিয়া ছিল একমাত্র হিন্দু। ওর কণ্ঠ ছিল কোকিলের মতো। স্কুলভবনের দোতলা থেকে সামনের পুকুরে হাঁসের সারি দেখা যেত। প্রিয়া প্রায়ই বলত, ‘দেখ ফারজানা, হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করে তোকে ডাকছে!’ ফারজানা রেগে যেত আর আমাদের হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা।

এই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে অজান্তেই ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি চলে আসে।

আরও পড়ুন

মিতু আর ইমা ছিল মানিকজোড়। সকালে এসেই কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত। আমরা আড়াল থেকে শোনার চেষ্টা করতাম কী বলে ওরা। ফারজানাকে কেউ কিছু বললেই ও সব সময় আমাকে ডাক দিত, ‘মী...ম!’ আর সবাই বলত, ‘তুই কথায় কথায় মীমকে কেন ডাকিস?’

টিফিনের সময় সবাই মিলে ঝালমুড়ি কিনে আনতাম। বেঞ্চের ওপর বসে ভাগ করে খেতাম, আড্ডা দিতাম। স্কুল ছুটির পরও গেটে দাঁড়িয়ে আধা ঘণ্টা গল্প করতাম। বাড়ি ফিরে এসেও মায়েদের ফোন দিয়ে এসএমএস করে কথা বলতাম।

আমাদের সঙ্গে ছিল আরও দুই বন্ধু—জয় আর মাহিম। মাহিমকে মজা করে ডাকতাম ‘মাইকেল’। ওর সঙ্গে হাসি, খুনসুটি, মারামারি লেগেই থাকত। জয় বলত, ‘আমরা নাকি পিঁপড়াদের মতো হাঁটি!’ স্কুল ছিল প্রায় এক মাইল দূরে, সেই পথটুকু হেঁটে আসা–যাওয়াতেই ছিল বন্ধুত্বের সবচেয়ে মধুর সময়।

কিন্তু এখন? এই শহরের পাঁচ মিনিটের রাস্তা যেন পাঁচ ঘণ্টা লাগে। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত—কেউ পড়াশোনায়, কেউ সংসারে, কেউ বাচ্চা নিয়ে। সবকিছু এখন স্মৃতি। রাস্তার পাশের গাছ থেকে কাঁচা ফল চুরি করে খাওয়া, ধরা পড়লে দৌড়ে পালানো, সেগুলো এখন শুধুই গল্প।

বলতে বলতে চোখের কোণটা ঝাপসা হয়ে এল। ভাবলাম, পাখিটা বুঝি উড়ে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি—না, শালু এখনো বসে আছে। চুপচাপ শুনছে আমার কথা। ঠিক তখনই আরেকটা শালিক এসে তার পাশে বসল। তারা দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখে মনে হলো, বুঝি কুশল বিনিময় করছে। তাদের দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম—
‘ইস্, আমিও যদি তোদের মতো পাখি হতাম,
আমারও যদি তোদের মতো দুটো ডানা থাকত,
তাহলে আমিও উড়ে চলে যেতাম—
আমার সেই বন্ধুদের কাছে, আমার সেই দিনগুলোর কাছে।’

শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ