তোমারে কে ভালোবাসে (পর্ব তিন)

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
ধ্রুব এমনিতেই আবেগপ্রবণ। চোখের জল তার দুই চোখের বিষ। কারও চোখে জল দেখতে পারে না। তার ওপর মায়াময় গানটা শুনতেই মন আরও নরম হয়ে গেছে।

: ঢাকা শহরের রাস্তায় তোমার সঙ্গে কম তো হাঁটলাম না। টিএসসির তেঁতুলের চা থেকে কারওয়ান বাজার কুমড়োপট্টির দুধের চা, কোনোটায় তো বাদ রাখিনি। এই চিনলে আমারে?
: কেবল বেশি বেশি কথা। বল তো ভালোবেসে পেতে চায় না কে? আমি কখনো তোর মতো কাউকে বলতে শুনিনি ‘ভালোবাসলেই পেতে হবে কেন?’
: আমিও তো পেতেই চাই। বৃষ্টির দুপুরে বলতে চাই, ইলিশ মাছ ভাজা খিচুড়ির সঙ্গে খাব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন সাজবে, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাই, ‘তুমি স্বচ্ছ জলের মতো সুন্দর।’ শাড়ির কুঁচি ধরে বলতে চাই, ‘মেকআপ ছাড়াই সুন্দর তুমি। মেকআপ তোমার সৌন্দর্য কমিয়ে দেয়।’ কিন্তু আমার যে ভাগ্য, ধরতে গেলেই তো নাই হয়ে যায়। ওই যে কথায় বলে না, অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়।
: একটা মেয়ের নাগাল পাচ্ছিস না বলে এত আফসোস। আর নাগাল পাওয়ার চেষ্টা তো করছিস না। ব্যাপারটা এমন, তুমি মনে মনে ভালোবেসেছ। কিংবা ইশারায় ঠারেঠোরে একটু বুঝিয়েছ। মেয়েটা নাচতে নাচতে এসে বলবে, ‘এই ছেলে, কিসের এত ভাবনা তোমার, আমি তো আছি?’ এত সহজ, তাই না। তা ছাড়া কম প্রাপ্তি আছে জীবনে? নিজেরে নিয়ে তুই এমন ভাবিস, মামা–মামি জানলে বড় কষ্ট পাবে রে। আমিও বড় কষ্ট পেলাম। নিজেরে অভাগা ভাবিস। বুকে লাগল ভাই, বুকে লাগল। যোগ্যতায়, দক্ষতায় তোর মতো সামর্থ্যবান তরুণ সচরাচর তো চোখে পড়েনি। কী নেই তোর—ভালোবাসা? একদিন দেখবি মনে হবে, এর চেয়ে হালকা বিষয় দ্বিতীয়টি আর নেই। জীবন ভয়াবহ রকমের সুন্দর, বিষণ্ন সুন্দর। তুই তো জ্ঞানী, বিচক্ষণ—এভাবে ভাবিস না। চল, চায়ের দোকানে গিয়ে বসি। চা খেয়ে যে যার গন্তব্যে যাব।
: আচ্ছা, তোমার কথা মেনে নিলাম। এবার একটা কাজ করো না দাদা, দোকানদারের কাছে বাকির খাতাটা একটু দেখতে চাও না প্লিজ। থানার সবাই কি পয়সা দেয় ঠিকমতো। দু-একজন এমনও কি নেই, যারা পয়সা না দিয়ে বাকিতে খেয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন?
: তোর ভাবনাও বলিহারি। লোকটা কাঁদছে কেন? চল, গিয়ে দেখি। একটা খবর পাওয়া গেলে আজকের কেপিআই পূরণ হবে।

মধ্য চল্লিশের মোটামুটি সুপুরুষ চেহারার একজন লোক। মাথার চারপাশে চুল, ভেতরটা ফাঁকা। অনেকে এ ধরনের মাথাকে বলে স্টেডিয়াম। পোশাক দেখে বেশ জুতসই পরিবারের মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। হাতে টাইটানের ঘড়ি। রিচম্যানের টি–শার্ট। প্যান্টটাও বেশ দামি। হালকা আকাশি ও নীল রঙের মিশ্রণের জিনস। জুতা অ্যাপেক্সের, লোফার। এমন সচ্ছল মানুষের চোখে জল মানায় না। ‘কী সমস্যা, কাঁদছেন কেন?’ ধ্রুব প্রশ্ন করতেই লোকটা সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ধ্রুবও গেল পেছন পেছন। একটা প্রিমিও গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। দরজা খুলে উঠতে যাবে, তখনই ধ্রুব হাত টেনে ধরল পেছন থেকে। তীর্থ পেছন থেকে চিৎকার করে বলল, ‘এই ধ্রুব করিস কী?’ লোকটা কোনো রিঅ্যাক্ট না করেই ধ্রুবর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ‘বিরক্ত করছেন কেন? খবর দরকার। আপনার সঙ্গের লোকটা তো সাংবাদিক। আমি চিনি, নামডাক আছে তার।’
: দুঃখিত। ক্ষমা করবেন। আপনার চোখে জল দেখে মনে হলো সমস্যায় আছেন। তাই নিজেকে সামলাতে পারিনি। আপনি যান। আমি খুবই সরি।
: তীর্থ বাবুকে ডাকেন। আমার বাসায় চলেন। একসঙ্গে বসে কথা বলব। তবে শর্ত হচ্ছে, তীর্থ বাবু বিষয়টা নিয়ে লেখালেখি করতে পারবেন না। আর লিখতে চাইলেও আমার নাম–ঠিকানা ব্যবহার করবেন না।

আরও পড়ুন

ধ্রুব আড়ালে নিয়ে কথাটা বললে রেগে গেল তীর্থ। ‘লেখার বিষয় হলে অবশ্যই লিখব। এসব শর্তটর্ত নিয়ে আমি যেতে পারব না।’ অনেক অনুনয়–বিনয় করলে তীর্থ রাজি হলো। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল। আর ধ্রুব বসল ভদ্রলোকের পাশে। ড্রাইভারকে গান ছাড়তে বলল ভদ্রলোক। ‘জীবনে যারে কভু দাওনি মালা,/ মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল?’

ধ্রুব এমনিতেই আবেগপ্রবণ। চোখের জল তার দুই চোখের বিষ। কারও চোখে জল দেখতে পারে না। তার ওপর মায়াময় গানটা শুনতেই মন আরও নরম হয়ে গেছে। নদীর কথা মনে করতেই প্রথম দেখার স্মৃতি ভেসে উঠল চোখে।

রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। মেয়েটা কথা বলছে, টিয়া পাখির মতো ঠোঁট নাড়িয়ে। চারপাশে রামধনু ঝরার মতো মুগ্ধতা ঝরে পড়ছে। সালোয়ার–কামিজে কাউকে এত সুন্দর লাগতে পারে, ওই দিনের আগে কখনো মনে হয়নি ধ্রুবর। নদীর কথা শেষ হতেই করতালিতে ফেটে পড়ল মিলনায়তন। এমবিএর ক্লাস মুহূর্তে হয়ে উঠল সাহিত্যের আসর। ধ্রুব ডায়েরিতে নদীর সম্পূর্ণ নাম লিখে নিচে লিখল, ‘কী ভীষণ নির্মমতা নিয়ে
বেঁচে আছি ঈশ্বর, সব তুমি জানো
নিয়ত অঞ্জলির পুণ্যে হলেও
তোমার এই প্রিয় ফুল আমারে দিয়ো।’

চলবে...