তোমারে কে ভালোবাসে (পর্ব দুই)

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

: সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?
: আচ্ছা, তুই না ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অনেক অ্যাকটিভ ছিলি। গান গাইতিস। লেখালেখিও তো ফার্স্ট ইয়ার থেকেই শুরু করেছিলি। কেউ কি ছিল না, নেই; তোকে পছন্দ করে, এখনো খোঁজখবর নেই?
: রাত্রি। ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়। আমি যেবার বের হই, সেবার ও ফার্স্ট ইয়ারে সদ্য ভর্তি হয়েছে। একটা প্রোগ্রামে উপস্থাপনা করার জন্য ওকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু ফোন ধরে না। তারপর ক্যাম্পাসে আসলে ঝাড়ি দিয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানের পর থেকেই মনে হয়েছে, আমার প্রতি ওর একটা দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন করে। গতকালকেও ফোন করেছিল। ক্যাম্পাসে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করবে, কিন্তু একটা ঝামেলা তৈরি হয়েছে। তখন আরও নানা কথা হলো। রাত্রি অনেক ভালো মেয়ে। আমি ওর উপযুক্ত নই। এসএসসি, এইচএসসি সব কটিতে বৃত্তি পাওয়া মেয়ে, ওর বাবা শিক্ষক। মা ব্যাংকে চাকরি করেন।
: বলি কি, ফাতরামি বাদ দিয়ে, রাত্রিকেই জীবনের ধ্রুবতারা করো। ওই যে রবীন্দ্রনাথের গানে আছে না, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,/ এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।’ তাহলেই জীবনে শান্তি পাবা। মামি, মানে তোমার মা যেমন যত্নে রাখে তোমারে। দেখবা, রাত্রিও তোমারে তেমনই যত্নে রাখবে। রাতে বই পড়তে পড়তে চশমা চোখে দিয়ে না ঘুমিয়ে পড়ো। আলগোছে চশমা খুলে মাথা বালিশে দিয়ে চাদর দিয়ে দেবে গায়ে। রাতে দেরি হলে ভাত না খেয়ে বসে থাকবে। যা বলবা সব শুনবে। রবীন্দ্রসংগীত না ভালোবাসো। বৃষ্টির দিনে গেয়ে শোনাবে। পুরুষ মানুষের চাহিদার তো শেষ নেই। তা ছাড়া তোমারে তো আমি চিনি। যে প্রবল অধিকারবোধ তোমার। রাত্রির কাছেই নিজেকে সমর্পণ করো। রাত্রি মুক্তোকে মুক্তোর সম্মান দিয়েই সিঁথিতে রাঙিয়ে রাখবে। জানো তো, মেয়েরা যাকে ভালোবাসে তাকে অদেওয়ার মতো কিছু রাখে না। প্রকৃতির মতো মেয়েরাও উজাড় করে দিতে জানে। এই যে পৃথিবী এত নির্মমতার মধ্যেও মমতা পায়, তা কেবল মায়েদের জন্য।

আরও পড়ুন

: জীবনের কোনো কিছুই কি আমাদের হাতে আছে—তুমি না ওপাড়ার অথৈ দিদিকে ভালোবাসতে। দিদিও তো তোমাকে ভালোবাসত। তোমরা কি একসঙ্গে থাকতে পেরেছ? পারোনি। গোঁয়ার্তুমি করে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে গেলে দুজনে। ভালোবাসতে জানলে শামুককেও মুক্তো বানিয়ে নেওয়া যায়। আর না জানলে মুক্তোও ধুলো-কাঁকর বালুর মতো তুল্যমূল্য হয়েই থেকে যায়। পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতাটা মনে আছে না, ‘সবাই মানুষ থাকবে না/ কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কেউ কাঁকর ও বালি।’
: ভালোবাসা তো অনেক বড় ব্যাপার। ভীষণ প্রেম–ভালোবাসা ছাড়াও কেবল আবেগের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। যা একটু ফসকে গেলেই খুচরো পয়সা পড়ার শব্দের মতো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে। কিন্তু ভাই, তুই এত বড় হয়ে গেলি কবে? ভেবেছিলাম, এখনো আবেগে ভেসে বেড়াচ্ছিস। সত্যি ভাই, এত বড় হয়ে গেলি কবে? নদী ভাগ্যবতী। ঢেউয়ে-জলে জোয়ার-ভাটায় যদি তোকে আঁকড়ে রাখতে পারে তবে চিরসুখী হবে। আচ্ছা, যে কারণে এদিকে আসা। আমার অফিস আইডি কার্ডটা হারিয়ে গেছে। একটা জিডি করতে হবে। তুই কি যাবি আমার সঙ্গে?
: দেশবরেণ্য, প্রভাবশালী সাংবাদিক তীর্থ বর্মণের অফিস আইডি কার্ড নিতে জিডি করতে হবে? তার চেয়ে বড় কথা, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস হারায় কী করে?
: বললে, যে অফিস দিত না, সেটা না। তারপরও রুলস মেনে চলা ভালো। আর গাধা, সেদিন একটা খবর পেয়ে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। পরে তো হুলুস্থুলের মধ্যে পড়েছিলাম। ওই দিনই দৌড়াদৌড়ির সময় কোথাও পড়ে গেছে। তুই যাবি আমার সঙ্গে?
: কোনো কাজে কখনো তোমাকে ‘না’ করেছি। রেডি হয়ে আসছি, দাঁড়াও।

দুই
: আগে কখনো থানায় এসেছিস?
: না, আসিনি। তবে এক কর্মকর্তার বাসায় তাঁর ছেলেকে পড়াতাম। তাঁর ঘরে সব ডাবল ডাবল ছিল। টিভি থেকে শুরু করে সব ইলেকট্রনিকস দুটো করে। বসার ঘরটাও ছিল দেখার মতো। সম্পূর্ণ ঘরটা বই আর শোপিস দিয়ে সাজানো। ছাত্রের মুখে শুনেছি, ওরা বছরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বই কিনে কেবল ঘর সাজানোর জন্য।
: এখন এখানকার দায়িত্বে যে ডিসি, সে আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে এলাম। ডাকছে আমাদের, চল।
:  অভিনন্দন, কমিশনার সাহেব, কেমন আছেন?
: তীর্থ, তীর্থ ও মাই ফ্রেন্ড। কত দিন পর দেখা। ও কে?
: আমার মামাতো ভাই, ধ্রুব। পুরো নাম, ধ্রুব ব্যানার্জি।
: হাই, ধ্রুব, হাউ আর ইউ? তোমার দাদা আর আমি একসঙ্গে এক রুমে এক হলে থেকেছি। আজ যে আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি, সেখানে তোমার দাদার অনেক অবদান।
: কমিশনারের শুধু বেশি বেশি। ধ্রুব তেমন কিছু না, ও কৃতজ্ঞ মানুষ। তাই অমন বলে।
: কমিশনার, তুমি তাহলে কাজটা করে দাও আমার। বেশি সময় তো হাতে নেই। তা ছাড়া তুমি ব্যস্ত মানুষ। তোমার সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
: বস, বস। তোর ইনফরমেশনগুলো আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিলি? না পাঠিয়ে থাকলে কীভাবে হারিয়েছে বিবরণ লিখে পাঠা।
: ক্ষমতা, পরিচয় থাকলে সব কাজ কত সোজা, তাই না দাদা। দেখ কত সহজে তোমার কাজটা এসি রুমে বসে হয়ে গেল? কিন্তু একজন রিকশাওয়ালা বা সবজি বিক্রেতার জন্য কাজটা কতটা জটিল!
: হেসো না; কিছু বলো?
: যে বিষয়ে কেবল যুক্তি আছে উত্তর নেই, তা নিয়ে আলোচনা করা বোকামি। প্রশ্ন করাও মূর্খতা। আচ্ছা, ওসব রাখ। বলি কি শোন নদীর সম্পর্কে একটু খোঁজখবর কর। মেয়েটা কেমন? কী ভালোবাসে, বাড়িতে কে কে আছে, মামার বাড়ি কোথায়, বাবা কী করে, মা কী করে, পছন্দের কেউ আছে কি না?
: আমি ভালোবাসি এটুকুই। খোঁজখবর করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার জন্য ও কোনো অসম্মান বা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ুক, আমি তা চাই না।
: আরে গাধা। ভালোবাসিস কিন্তু পেতে চাস না? আশ্চর্য এ কেমন ভালোবাসা। এ তো একটা ফাঁদ, মেয়েটা তোরে ভালোবেসে ফেললে তুই তো কষ্ট দিবি ওরে?

চলবে…