চিঠি
বাসুন বারোতে (পর্ব ১৮)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।
বাসুন,
নীলাব এসেছে ইরাক থেকে।
নীল নদের সঙ্গে মিলিয়ে নীলাব নিজের নাম রেখেছে। ৩০ বছর বয়সী নীলাব এখনো পুরোপুরি মেয়ে হয়নি; মানে নীলাব একজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষ। আমাদের অফিসে এসেছে মাত্র তিন দিন আগে। গতকাল ৩৩ জনের একটা দল নিয়ে গিয়েছিলাম ডাউনটাউন টরন্টোর সার্ভিস কানাডা অফিস আর ব্যাংকে। দলের সঙ্গে আরও ছিল কাদির, লাজদা, সাহার, রেজা, রিতা, আরাফা, হামজা, সগুন, লাগুন, খলিলজান মেহেরজান, আব্রাজ, বাইদুন। সবাই হাঁটছে দল বেঁধে, সঙ্গে আমিও।
কস্টি রিফিউজি শেলটার থেকে আমার জন্য নির্ধারিত কাজ হলো, এদের সিন কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও পি-আর কার্ডের জন্য পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া; সঙ্গে আছে ইরাকি স্বেচ্ছাসেবক ছাত্র হারুন, যে আরবি ও ফারসি ভাষায় কথা বলতে পারে।
এই বিশাল দলের কেউই মৌলিক ইংরেজিও পারে না বললেই সত্য বলা হবে। কিন্তু এই সব মানুষ কানাডায় স্থায়ী হবে, বাকি জীবন কানাডায় থাকবে; এমন স্বপ্ন নিয়েই দেশ ছেড়েছে। যেমন আট বছর আগে আমি ছেড়েছিলাম।
কিন্তু আমার ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডায় আসা আর ওদের আসার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এই ৩৩ জনের দল প্রথম এক বছর কানাডা সরকারের সব ধরনের সহযোগিতা (অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্যসেবা, বাসাভাড়া ও হাতখরচ) পাবে, যা আমার মতো অভিবাসীর ছিল না। কারণ, কানাডার সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য যুদ্ধবিধস্ত দেশের মানবিক চুক্তি আছে। সেই শর্ত অনুযায়ী এই ৩৩ জন কানাডা সরকারের কাছে গভর্নমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স রিফিউজি মানে এরা সরকারের অতিথি; যত দিন তারা স্বাবলম্বী না হচ্ছে।
৩০ বছর বয়সী নীলাব তাই স্বপ্নে বিভোর। ফরসা দুধে–আলতা গায়ের রং নীলাবের, একহারা গড়ন, ঘাড় অব্দি মেয়েদের মতো রেশমি চুলে বারবার হাত রাখছে, মুখ থেকে চুল সরাচ্ছে মেয়েদের মতো করে, হাঁটছেও মেয়েদের ভঙ্গিতে। ভ্রু প্লাক করা, চোখে আইলাইনার, ঠোঁটেও হালকা গোলাপি লিপস্টিক। যদিও শারীরিকভাবে নীলাব এখনো ছেলে। ও হয়তো আরও কিছু অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসার পর পুরোপুরি মেয়ে হয়ে যাবে।
এখন থেকেই নীলাব ভাবতে ভালোবাসে। মেয়ে হলে ও কীভাবে নিজেকে সাজাবে, অফিসের আরেক সহকর্মী ত্রিনিদাদের মেয়ে জাহিদার সঙ্গে আলাপ করে নীলাব। মেয়ে হলে জাহিদার মতো ফ্যাশন করবে। নিজেকে খুব সুন্দর করে সাজাবে ও।
রাস্তায় হাঁটার সময় নীলাব আমাকে বারবার বলে, ‘জানো লুনা, কানাডায় জীবন ফিরে পেয়েছি। বাগদাদে তিন বছর অমানবিক জীবনযাপন করতাম। সবাই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকাত। আমি কিছুতেই নিজেকে নিয়ে স্বস্তি অনুভব করতাম না। তারপর তো না পেরে কানাডায় মানবিকভাবে বাঁচার জন্য আবেদন করি। তিন বছর অপেক্ষা করে এই দেশে এসেছি। কী সুন্দর দেশ কানাডা! আমি জানি, আমি যখন ট্রান্সজেন্ডার সোসাইটিতে যাব, আমি খুব ভালো থাকব। আমার জবের কোনো অসুবিধা হবে না। আমি তো বাগদাদে টিভিতে কাজ করতাম। আমি কেবল ভাবি, কবে ভালো করে ইংরেজি বলতে পারব। লুনা, তুমি কি বলতে পারো, কবে আমি ইংরেজি ক্লাসে যাব?’
কথা বলতে বলতে নীলাব ভ্রু নাচায়, চোখের সামনে থেকে রেশমি চুল সরায়, রোদের আলো ছাপিয়ে ওর মেকআপ করা মুখে কালো দাড়ির আভা ফুটে ওঠে।
জানিস বাবু, আমি বুঝতে পারি, নীলাব জানে না, আমি কী চোখে ওকে দেখছি! ট্রান্সজেন্ডার, লেসবিয়ান, গে, হোমোসেক্সুয়াল—এসব বিষয় থেকে আমাদের দেশ কত বছর পিছিয়ে পড়ে আছে, সে খবর নীলাবের জানার কথা নয়। নীলাবের সেই ধারণাই নেই। নেই বলেই হয়তো ও আমার সঙ্গে খুব সহজ করে কথা বলে। মনে মনে হিসাব মেলাই, রংপুরের এক মধ্যবিত্ত কলেজশিক্ষকের ঘরে যেদিন জন্মগ্রহণ করেছিলাম, সেদিন কি আমার ঠিকুজিতে লেখা ছিল, এই জীবনেই আমি এমন মানুষদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পাব? একদল মানুষকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে জীবনকে গভীর করে দেখার এমন মহান ভাগ্য হবে!
বাবু, এই রিফিউজি অফিসে টেবিলের সামনে একটা লাইন লেখা আছে। যার অর্থ, প্রত্যেক নতুন মানুষকে দেখা মানেই একটি পবিত্র ঘটনা।
আসলেই কিন্তু তা–ই। জীবনে অনেক অনেক না–পাওয়া আছে, এমন হাহাকার আছে আমার যা মনে হলে ভেতর থেকে সব আনন্দ মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। বেঁচে থাকার সামান্য অর্থ আমাকে শক্তি দিতে পারে না। কিন্তু এই যে প্রাপ্তি, এই যে এত এত মানুষের সঙ্গে সারা মাস ধরে পরিচিত হওয়া, সারা জীবন ধরে যেসব মানুষ জানবে যে কানাডার প্রথম কয়েকটা দিন আমি ছিলাম ওদের সঙ্গে, এই ভাগ্যকে কী দিয়ে মাপব আমি? এই কানাডায়, এই সব ভিনদেশি মানুষ যত বেশি দিন থাকবে, তত দিন কস্টিকে মনে রাখবে, সঙ্গে আমাকেও মনে রাখবে। কারণ, আমিও এক মিনিটের জন্য ভুলি না, যারা আমাকে এই দেশে স্থায়ী হওয়ার জন্য প্রথম কয়েক মাসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল।
তাহলে দেশ ছেড়েছিলাম কেন? প্রিয় মানুষ থেকে দূরে আসার জন্য মরিয়া হয়েছিলাম কেন? মনের ভেতর গুমড়ে পড়ে থাকা প্রশ্নের কোনো জবাব আমার জানা নেই...
আজ আবার সেই ছুটির দিন। তুই গেছিস লাইব্রেরিতে। আমি বাসায় একা। তোকে লিখতে বসে ভাবি, নীলাব একদিন পুরোপুরি মেয়ে হবে; এই শহরে ওর স্বপ্নের দিনগুলো সাজিয়ে নেবে। ৭০ বছর বয়সী হারমাস এই শহরে ৫ বছর পর নিজের বউ-বাচ্চার কাছে ফিরে এসেছে। ৩৪ বছর বয়সী রাদ ইরানে নামকরা সংগীতশিল্পী, কিন্তু ইরানের রাজনৈতিক দাঙ্গা রাদকে অস্থির করেছে। সে কানাডায় এসেছে সুস্থ জীবনের আশায়।
বাসুন, একদিন তোকে নিয়ে বাংলাদেশে পথ চলতে গিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সে সময় মনে হয়েছিল, পৃথিবীর কোন দেশে গেলে নীরবে–নিভৃতে বাস করতে পারব? কোন পরিবেশে থাকলে মানুষ আমাকে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন করবে না? কোন দেশে গেলে নিজেকে গড়ে তুলতে পারব, নিজের জীবনের জন্য অসহায় বোধ করব না?
এমন সব ভাবনাই কিন্তু আমাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। সবার জন্যই এই বোধ সত্য। কিন্তু হায়, মানুষ যা একদিন ছেড়ে আসে, সেখানেই পড়ে থাকে তার মন–প্রাণ।
এই যে সারা সপ্তাহ পরে তোকে একটুকরো চিঠি লিখতে বসি, ভাবতে ভালোবাসি যে দেশের মানুষেরা এই জীবনটা জানবে, লেখা ফেসবুকে শেয়ার দিই; বাংলাভাষী মানুষ, ফেলে আসা প্রিয় মানুষেরা আনন্দ–বেদনার সঙ্গী হবে, সেই অপেক্ষায় কাটে বাকি দিনগুলো।
তাহলে দেশ ছেড়েছিলাম কেন? প্রিয় মানুষ থেকে দূরে আসার জন্য মরিয়া হয়েছিলাম কেন? মনের ভেতর গুমড়ে পড়ে থাকা প্রশ্নের কোনো জবাব আমার জানা নেই সোনাবাচ্চা। কিন্তু জীবনবোধের এই দোটানার বাইরে থাক তুই, সেই কামনা করি।
নীলাব একদিন পুরোপুরি মেয়ে হয়ে এই শহর মাত করুক, ওর জন্যও আগাম শুভেচ্ছা।
তোর মা,
২০ অক্টোবর, ২০১২
স্কারবোরো, টরন্টো, কানাডা