ভালো সময়ে নিজেকে কখনো সুপারহিরো মনে করিনি

রাফায়েল নাদালএএফপি

টেনিসের ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় স্প্যানিশ কিংবদন্তী রাফায়েল নাদাল। ২৩ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারে ২২টি গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪টি জিতেছেন ফ্রেঞ্চ ওপেনে। ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে নাদাল জিতেছেন ৯২টি শিরোপা। অন্য দুই কিংবদন্তি রজার ফেদেরার আর নোভাক জোকোভিচের সঙ্গে যেসব ধ্রুপদি দ্বৈরথ উপহার দিয়েছেন, ইতিহাসের পাতায় সোনালি হরফে খোদাই করা থাকবে তাঁর নাম।

নভেম্বরে পেশাদার টেনিস থেকে অবসর নিয়েছেন ৩৮ বছর বয়সী নাদাল। সম্প্রতি প্লেয়ারস ট্রিবিউনে দেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন টেনিস খেলায় আসার গল্প; কথা বলেছেন চোট, খারাপ লাগা-ভালো লাগার মুহূর্ত নিয়ে। দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের জন্য পরামর্শও। সেই সাক্ষাৎকার অনুবাদ করে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—

বাল্যকালের শিক্ষা
তখন আমার বয়স ১২ বছর হবে হয়তো। ওই বয়সে মাছ ধরা পছন্দ করতাম। সমুদ্র ভালোবাসতাম। আমার বাড়ি ম্যালোরকান দ্বীপে। সমুদ্র আমার জীবনের একটি অংশ। সমুদ্রের কিনারায় পাথরের ওপর বসে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে মুহূর্তগুলো উপভোগ করা, অথবা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়া—ওই মুহূর্তে বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং শান্তির যে অনুভূতি, তা বিশেষ কিছু।

একদিন টেনিস খেলার অনুশীলন না করে মাছ ধরতে চলে গেলাম। পরদিন খেলায় হেরে যাই। আমার ঠিক মনে আছে, বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে বসে কান্না করছিলাম; পাশে বসা আঙ্কেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘এটি কেবল একটি টেনিস ম্যাচ। কান্না করো না এখন, কোনো লাভ নেই। যদি তুমি মাছ ধরতে চাও, ধরতে পারো। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি টেনিস ম্যাচে পরাজিত হবে। আর যদি জিততে চাও, তাহলে তোমাকে সেটাই প্রথমে করতে হবে।’ আমার জীবনে এই আঙ্কেলের বিশাল প্রভাব রয়েছে। তিনিই আমাকে টেনিসের প্রতি ভালোবাসতে শিখিয়েছেন।

স্প্যানিশ তারকা রাফায়েল নাদাল
এএফপি

ঘটনাটি আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ছিল। যদি মানুষ আমাকে পারফেক্টশনিস্ট হিসেবে দেখে, সেটা আঙ্কেলের ওই কথাগুলোর কারণে। যে কণ্ঠটি কখনোই আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমাকে অনুশীলন করে যেতেই হবে।

স্বপ্ন দেখার শুরু
ছোটবেলায় খেলাধুলায় আমার কোনো আইডল ছিল না। আমার নায়ক বাস্তবজীবনের মানুষেরা। মাত্র ১২ বছর বয়সে কার্লোস মোয়ার সঙ্গে প্রথমবার খেলার সুযোগ পাই। তিনি ছিলেন ফ্রেঞ্চ ওপেন চ্যাম্পিয়ন এবং প্রথম স্প্যানিশ ‘নাম্বার ওয়ান’ টেনিস খেলোয়াড়। তাঁর বাড়িও ম্যালোরকানে। ওই ম্যাচে খুবই নার্ভাস ছিলাম। ব্যাটে অল্প কয়েকটি বলই লাগাতে পেরেছিলাম। এটি ভুলে যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা। কিংবা এভাবে বলা যায়, অন্য দুনিয়ায় (পেশাদার টেনিস) পা রাখার প্রথম ধাপ। তখন টেনিস আনন্দের জন্য খেলতাম। সেই ম্যাচ খেলাটিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার উপলক্ষ এনে দেয়। আমাকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে, একদিন হয়তো আমি ফ্রেঞ্চ ওপেনে খেলতে পারব।

ভালো সময়ে নিজেকে কখনো সুপারহিরো মনে করিনি। আবার খারাপ সময়ে নিজেকে কখনো ব্যর্থ ভাবিনি।

চোট থেকে শিক্ষা
১৭ বছর বয়সে ভয়ংকর চোটে পড়ি। আমাকে বলা হলো, আর কখনোই পেশাদার টেনিস খেলতে পারব না। তখন শিখেছি, যেকোনো কিছুই তাত্ক্ষণিকভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে। এটি কেবল আমার পায়ের ছোট একটি ফাটল নয়, এটি একটি রোগ। রোগটির কোনো প্রতিকার নেই, শুধু নিয়ম মেনে চলতে হবে। রোগের নাম মুলার-ওয়েইস সিনড্রোম। এটার মানে কী? বিষয়টা এমন যে দারুণ অনুভূতি নিয়ে আপনি রাতে ঘুমাতে গেলেন, আর সকালে উঠে দেখলেন হাঁটতে পারছেন না। অনেক দিন বাড়িতে বসে কান্না করেছি। এটা ছিল বড় একটা শিক্ষা।

আমি গর্বিত আমার একজন বাবা আছেন, যিনি সব সময় পজিটিভ থাকেন এবং আমার জীবনে সত্যিকারের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো সমাধান খুঁজে নেব। আর যদি না খুঁজে পাই, টেনিসের বাইরেও আরও অনেক কিছু করার আছে।’

ওই কথাগুলো শোনার পর ধীরে ধীরে নিজেকে শান্ত করতে পারি। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, অনেক ব্যথা, সার্জারি, বিশ্রাম ও কান্নার পর একটা সমাধান খুঁজে পাই, যা পরবর্তী সময়ে আমার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

পুরো বিশ্ব যা দেখে, ভেতরের প্রতিচ্ছবি সম্পূর্ণ ভিন্ন
৩০ বছর ধরে পুরো বিশ্বকে আমি নিজের যে প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছি, তা সব সময় আমার ভেতরের প্রতিচ্ছবি ছিল না। সত্যি বলতে, যত ম্যাচ খেলেছি; প্রতিটি ম্যাচের আগে আমি নার্ভাস থাকতাম। ম্যাচের আগের রাতে, খেলার দিন সকালে মনে হতো—আমি ম্যাচটা হেরে যেতে পারি। টেনিসে খেলোয়াড়দের মধ্যে পার্থক্য খুবই অল্প এবং প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের সঙ্গে সেটা আরও কম। যখন আপনি কোর্টে যাবেন, যেকোনো কিছুই হতে পারে। আপনার শরীরের প্রতিটি সেন্স জীবিত থাকতে হবে। সেই অনুভূতি, ভেতরের আগুন ও নার্ভাসনেস, দর্শকে পরিপূর্ণ একটি কোর্টের বাইরে হাঁটা ও দেখা—এটি এমন এক অনুভূতি, যা বর্ণনা করা কঠিন। খুব কম মানুষই এটা বুঝতে পারে। পেশাদার টেনিস থেকে অবসর নেওয়ায় এই অনুভূতি হয়তো আর কখনোই পাব না।

ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় এই অনুভূতিগুলো খুব ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কয়েক বছর আগে মানসিকভাবে আমাকে খুবই কঠিন সময় অতিবাহিত করতে হয়েছিল। শরীরের ব্যথাকে জীবনের অংশ মনে করতে শুরু করি। কোর্টে এমনও সময় গিয়েছে, যখন শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হচ্ছিল এবং নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে খেলতে পারিনি। এসব এখন বলতে কোনো সমস্যা নেই। দিন শেষে আমরা সুপারহিরো নই, আমরা মানুষ। সেন্টার কোর্টে ট্রফি হাতে আপনি যাঁকে দেখতেন, তিনি কেবলই একজন ব্যক্তি। ক্লান্ত, খুশি, কৃতজ্ঞ একজন মানুষ।

স্ত্রী মেরি পেরেয়োর সঙ্গে রাফায়েল নাদাল
ফাইল ছবি

সৌভাগ্যক্রমে উদ্বেগের মতো বিষয়গুলোকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। তবে প্রতিটি খেলোয়োড়ের জীবনেই এমন মুহূর্ত আসে, যখন এসব অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর যখন এমনটা ঘটে, তখন খেলায় মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন। এমনও মুহূর্ত এসেছিল যখন মনে হয়েছিল, টেনিস থেকে পুরোপুরি বিরতি নিই। নিজেকে সুস্থ করার জন্য এই ব্যাপারগুলো নিয়ে প্রতিদিন কাজ করেছি। সব সময় নিজেকে সামনে ঠেলে দিয়েছি এবং ধীরে ধীরে আবার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতাম। স্ট্রাগল করলেও কখনো হাল ছেড়ে দিইনি—এই ব্যাপারটা নিয়ে সব সময় গর্ববোধ করি। সব সময় নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েছি।

যাহোক, কখনোই নিজেকে সামনে এগিয়ে নিতে পিছপা হবেন না। কখনই রিল্যাক্স হওয়া যাবে না। সব সময় নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হবে, যা আমি মেনে চলি সর্বদা। নিজের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবেই আমি একজন ভালো খেলোয়াড়ে পরিণত হই।

টেনিস যখন বাস্তব জীবনের শিক্ষক
টেনিসকে বাস্তব জীবনের শিক্ষকও বলা যেতে পারে। অধিকাংশ সময়েই আপনি টুর্নামেন্ট জিতবেন না। আপনি কে, সেটা কোর্টে ম্যাটার করে না, কয়েক সপ্তাহ খেলে যাওয়ার পরও আপনাকে হারতে হবে। বাস্তব জীবনটাও এমনই। আনন্দ ও কষ্টের মুহূর্তগুলোতে কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে, তা আপনাকে শিখতে হবে। দুটি মুহূর্তকেই একইভাবে দেখতে হবে। ভালো সময়ে নিজেকে কখনো সুপারহিরো মনে করিনি। আবার খারাপ সময়ে নিজেকে কখনো ব্যর্থ ভাবিনি। ব্যর্থতা, নার্ভাস, কষ্ট, আনন্দ, প্রতিদিন জেগে ওঠার প্রক্রিয়া এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটু ভালো হওয়ার চেষ্টা করা—জীবনই আপনাকে একজন ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করবে।

প্রতিপক্ষকে সম্মান করা
সব সময় চেষ্টা করেছি অন্যদের সম্মান করতে। এটি ছিল আমার মা–বাবার দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষা। যখন ছোট ছিলাম, বাবা সব সময় আমাকে বলতেন, ‘আবিষ্কার করা কঠিন, নকল করা অনেক সহজ।’ এসব কথা টেনিস–সম্পর্কিত নয়, জীবন সম্পর্কে। বাবা বলতেন, ‘নিজের চারপাশে তাকাও এবং যে মানুষদের মূল্যায়ন করো তাঁদের দেখো—অন্যদের সঙ্গে তাঁরা কেমন আচরণ করে। তুমি তাঁদের কী কী পছন্দ করো, ভাবো। তাঁদের মতো হওয়ার চেষ্টা করো এবং তুমি সুখী জীবন উপভোগ করতে পারবে।’

আমার খেলা প্রতিটি ম্যাচে আমি এই শিক্ষা পালনের চেষ্টা করেছি। প্রতিপক্ষের ঘৃণ্য আচরণে কখনো উদ্বুদ্ধ হইনি, বরং সম্মান ও প্রশংসা করেছি। চেষ্টা করেছি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আরেকটু ভালো মানুষ হওয়ার। তবে এটি সব সময় সফল হয় না। তবু আমি চেষ্টা করি।

অর্জন
৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি এই খেলাকে সবকিছু দিয়েছি। বিনিময়ে অসংখ্য আনন্দ ও সুখের মুহূর্ত, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এবং আরও অনেক কিছু পেয়েছি।