‘কখনই অনুভব করিনি, আমি অন্ধ বা প্রতিবন্ধী’

শ্রীকান্ত বোল্লার বায়োপিক সিনেমায় শ্রীকান্ত চরিত্রে অভিনয় করেন রাজকুমার রাওছবি: সংগৃহীত

১৯৯১ সালের জুলাইয়ে যখন শ্রীকান্ত বোল্লার জন্ম হয়; দরিদ্র কৃষক মা-বাবা এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে মনে করেছিলেন, তাঁরা মিলিয়ন ডলারের লটারি জয় করে ফেলেছেন। মনে করার কারণও রয়েছে। বছরে মাত্র ২০ হাজার রুপি আয় করা একটি পরিবারের প্রথম সন্তান যে ছেলে হয়েছে। তবে এই ভাবনা বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁরা জানতে পারেন, তাঁদের সন্তান অন্ধ হয়ে জন্ম নিয়েছে এবং সারা জীবন এভাবেই থাকতে হবে। খুশি পরিণত হলো দীর্ঘশ্বাসে।

ভারতের অন্ধ প্রদেশের মাছলিপত্তনমের প্রত্যন্ত গ্রাম সিথারামাপুরামে জন্মগ্রহণ করেন শিল্প উদ্যোক্তা শ্রীকান্ত বোল্লা। অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও তা তাঁর জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রথম বিদেশি অন্ধ শিক্ষার্থী হয়ে পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান মাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)। এর আগে তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (আআইটি) ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্ধ বলে তাঁকে কোনো কোচিং সেন্টার ভর্তি প্রস্তুতির সুযোগ দেয়নি। এমআইটিতে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসেন এবং নিজের মেধা, আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টার মাধ্যমে আজ ভারতের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন শ্রীকান্ত বোল্লা। ‘বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে হায়দরাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি পরিবেশবান্ধব রিসাইক্লিনিং কোম্পানি। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান ও সিইও।

পৃথিবীতে আসা প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কিছু মহৎ উদ্দেশ রয়েছে
শ্রীকান্ত বোল্লা

কঠিন এই যাত্রাপথ নিয়ে তিনি জানান, জন্মের পর যখন মা–বাবা জানতে পারেন, ছেলে অন্ধ। তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা তাঁর কৃষক মা–বাবাকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘এটা বড় অভিশাপ…। জীবনে বড় কোনো পাপ করার কারণেই আজ এমন শিশুর জন্ম হয়েছে।’ তবে তাঁর অশিক্ষিত মা-বাবা সেসব কথায় পাত্তা দেননি। তাঁরা ছেলেকে গ্রহণ করে সব ধরনের ভালোবাসা ও যত্ন করে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। শ্রীকান্ত বোল্লা বলেন, ‘পৃথিবীতে আসা প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কিছু মহৎ উদ্দেশ রয়েছে।’

জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া
সিথারামাপুরাম গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। সেখানে পড়াশোনা করাটা ছিল বিলাসিতা। পরিবারের আয় এতটাই কম ছিল যে ভালোভাবে বেঁচে থাকাটাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেই অবস্থা থেকে আজকের অবস্থানে আসার পেছনে মা-বাবার হার না মানার মানসিকতাকে কৃতিত্ব দেন শ্রীকান্ত বোল্লা। শৈশবে তিনি বাবার সঙ্গে কৃষিখেতে গিয়ে কাজ করতেন, নারকেল পাড়তে গাছে উঠে যেতেন। শ্রীকান্ত বোল্লা বলেন, ‘সূর্যের আলোয় আমি সবকিছুই করার চেষ্টা করতাম। কখনই অনুভব করিনি, আমি অন্ধ বা প্রতিবন্ধী।’ এই মানসিকতাই তাঁকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।

মানসিকভাবে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও শ্রীকান্তকে শারীরিক ও সামাজিক অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন স্থানীয় যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি, সেটির দূরত্ব বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার। গর্ত ও অমসৃণ এই রাস্তা বৃষ্টির সময় কর্দমাক্ত হয়ে থাকত। হেঁটে এই পথে আসা-যাওয়া ছিল কষ্টকর। কষ্ট করে স্কুলে পৌঁছানোর পর সহ্য করতে হতো আরও ঝামেলা। পেছনের বেঞ্চে বসতে হতো এবং শারীরিক কোনো কাজে অংশ নিতে পারতেন না তিনি। নিজেকে খুবই একা মনে হতো। শ্রীকান্ত বোল্লা বলেন, ‘আমি বুঝতে পারলাম, একাকিত্ব হলো দরিদ্রতা। আমার কাছে লাঞ্চ বক্স ছিল না বলে নিজেকে দরিদ্র মনে হতো না, দরিদ্র মনে হতো একাকিত্ব ও চারপাশের পরিবেশের কারণে। বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে আনন্দ করার গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো আমি হারিয়ে ফেলি।’ সহপাঠীদের কেউ কেউ তাঁর এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কটাক্ষ করত।

শ্রীকান্ত বোল্লা
ছবি: সংগৃহীত

পরবর্তীকালে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে হায়দরাবাদে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একটি স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এই স্কুলে এসে জীবনের আনন্দ ও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান বোল্লা। প্রতিবছর মোধাতালিকায় প্রথম স্থানে থাকত তাঁর নাম। আন্তস্কুল প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে দ্রুত সময়ে ব্রেইল লেখা ও পড়ায় সবাইকে ছাড়িয়ে যান। দাবা খেলার কৌশলও আয়ত্ত করে ফেলেন। মা–বাবাকে ছাড়া থাকতে গিয়ে শিখতে হয়েছে কাপড় ধৌতকরণ, জীবনে চলার নতুন পদ্ধতি এবং হায়দরাবাদের স্থানীয় খাবার খাওয়া। তবে শুরুর দিকে স্কুলে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। স্কুল থেকে একবার পালিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন তিনি। নিরাপত্তা প্রহরী তাঁকে আটকে ফেলেন এবং শাস্তি হিসেবে একটি রুমে কয়েক ঘণ্টা বন্দী করে রাখেন। শ্রীকান্ত বোল্লা বলেন, ‘এরপরই আমি সিদ্ধান্ত নিই ক্যারিয়ার গড়ে তোলার। ঘটনাটি ছিল ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসের এবং ওই দিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত—আমি কখনো বিশ্রাম নিইনি।’

অধিকার আদায়ে শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই
ম্যাট্রিকের পর বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে চেয়েছিলেন শ্রীকান্ত বোল্লা। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তাঁকে ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। পরামর্শ দেওয়া হয় আর্টস, ভাষা কিংবা সামাজিক বিজ্ঞানের কোনো একটা নিয়ে পড়াশোনা করতে। তবে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না তিনি। শিক্ষা বোর্ডের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করেন এবং ছয় মাস পর মামলা জিতেও যান। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ৯৮ শতাংশ নম্বর এবং দ্বিতীয় বর্ষে প্রায় কাছাকাছি নম্বর পান শ্রীকান্ত। পড়াশোনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন তিনি। শ্রীকান্ত বোল্লা বলেন, ‘ব্যাপারটা বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা থেকে আসে না, এটা আপনার ডিএনএতেই থাকে। এমনকি আজও আমি বিভিন্নভাবে বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানাই। বিশ্বে চলমান পদ্ধতিকে ভয় পাই না। আমি আসলে কোনো কিছুকেই ভয় পাই না।’

সহানুভূতি আপনাকে ধনী করে তোলে
শ্রীকান্ত বোল্লা

ইন্টারমিডিয়েটের পর এমআইটিতে ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স বিষয়ে স্নাতক কোর্সে ভর্তি হন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরুর দিকে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে বিদেশের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তাঁকে স্বপ্নের পেছনে তাড়া করতে উৎসাহ জোগায়।

বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা
এমআইটিতে পড়ার সময়ই ২০১২ সালে হায়দরাবাদের একটি ছোট্ট বাড়িতে সহপ্রতিষ্ঠাতা রবি মানথার সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রিজ’। এমআইটির এক বন্ধুর মাধ্যমে মানথার সঙ্গে পরিচয় ঘটে শ্রীকান্তের। তাঁরা হায়দরাবাদের একটি হোটেলে প্রথম সাক্ষাৎ করেন। প্রাথমিকভাবে বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রিজে এক লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেন মানথা। শ্রীকান্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শ্রীকান্ত একজন আগ্রাসী এবং দক্ষ উদ্যোক্তা। সে টেকনিক্যালি দক্ষ। নেতা হিসেবে সে সহানুভূতিশীল ও যত্নশীল। তাঁকে ফ্যাক্টরির ফ্লোরে বসেও কাজ করতে দেখেছি।’

কোম্পানিটিতে শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কাজ করেন। শ্রীকান্ত বোল্লা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন, যাতে তাঁরা কেউ কোনো ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন না হন।

মাত্র পাঁচজন কর্মী নিয়ে কোম্পানির সূচনা হয়। বর্তমানে সেখানে শতাধিক কর্মী কাজ করছেন। পাশাপাশি পাঁচটি ম্যানুফ্যাকচারিং শাখা রয়েছে। ২০১৬ সালে রতন টাটা এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। করোনা মহামারির পূর্বে ১৩০ কোটি রুপির রাজস্ব অর্জন করে বোলান্ট। মহামারি আঘাত হানলে ব্যবসায় এর প্রভাব পড়ে। প্রায় ৯ কোটি রুপির ক্ষতি হয়। শ্রীকান্তের মতে, তৎকালীন সময়ে ক্ষতির এই অঙ্কটা মোটেই ছোট সংখ্যা নয়। করোনার পর প্রতিষ্ঠানটি আবার ঘুরে দাঁড়ায় এবং বর্তমানে রাজস্ব ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে রাজস্বের পরিমাণটা তিনি জানাননি।

অনুপ্রেরণা ও অর্জন
টিনএজ বয়সে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল শ্রীকান্ত বোল্লার। তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা মানেন অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভস জবসকে। নিজেকে একজন অসাধারণ নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করেন ৩২ বছর বয়সী এই যুবক। শ্রীকান্ত বোল্লা বলেন, ‘আমি আমার কাজ সম্পর্কে উত্সাহী। কাজ সবার আগে, বাকি সব পরে। একই সঙ্গে আমি খুবই আবেগী এবং মানবিক; মানুষের বিভিন্ন সমস্যায় উদার হওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, সহানুভূতি আপনাকে ধনী করে তোলে।’

২০১৭ সালে ফোর্বসের অনূর্ধ্ব-৩০ এশিয়ান ব্যক্তির তালিকায় স্থান পান তিনি। ২০২১ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফোরাম তাঁকে ‘ইয়াং গ্লোবাল লিডার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। গত মাসে ‘শ্রীকান্ত’ শিরোনামে বলিউডে শ্রীকান্ত বোল্লার বায়োপিক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজকুমার রাও। সিনেমাটি সর্বত্র প্রশংসিত হচ্ছে।

সূত্র: ফোর্বস ইন্ডিয়া