বাসুন বারোতে (পর্ব ১৪)

চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।

অলংকরণ: তুলি

বাসুন,

মাত্র ঘণ্টা দুই আগে আমাদের বাসা থেকে বিদায় নিল বালাজি দুখমে আর মারিয়াম দুখমে। ২০ বছরের মেয়ে মারিয়মের আসল নাম মালাকার ন্যাতে। অরিজিনালি জুইস মেয়ে, বালাজিকে বিয়ে করার পর ধর্ম বদলে মুসলিম হয়েছে।

আগের কোনো এক লেখায় বালাজিকে নিয়ে লিখেছিলাম। আফ্রিকার সিয়েরা লিয়নের হীরার খনি থেকে বালাজি কী করে কানাডায় ঢুকেছে, সে কথা সবিস্তার বলেছি অন্য কোনো এক লেখায়।

আফ্রিকান মুসলিম ছেলে বালাজির বয়স ২৩, কানাডায় রিফিউজি হয়ে এসেছে। বছর দেড়েক আগে অফিসের কাজে পরিচয় হয়েছে আমার সঙ্গে। এরপর ধর্ম বোন পাতিয়েছে। তোর নিশ্চয়ই মনে আছে বাবু, বালাজি অনেকবার এসেছে আমাদের বাসায়। তোকেও অনেক অনেক ভালো কথা বলে; যদিও সেসব কথা শুনে অভ্যস্ত না তুই, তাই বালাজির কথা তোর না বোঝারই কথা।

যেমন বালাজি তোকে বলে, ‘নাইয়া, তুমি জানো না বাবা-মা কী জিনিস। বিশেষ করে মা কাকে বলে তুমি জানবে না। জানো নাইয়া, আমার মা-বাবাকে কোনো দিন দেখিনি। আমি জানি না বাবা-মা দেখতে কেমন। তাই তোমাকে বলছি, মা তোমাকে যা বলবে, মনে রেখো সেটা শুধুই তোমার ভালোর জন্য।’

এই হচ্ছে বালাজি দুখমে। মাত্র আড়াই বছর আগে মন্ট্রিয়ল হয়ে কানাডায় প্রবেশ করেছে কোনো লিগ্যাল কাগজ ছাড়া। চার মাস আগে একদিন অসহায় হয়ে ফোনে বলছিল, ‘আমার কী হবে লুনা, আমাকে তো আইনজীবী রিজেক্ট করেছে। বলেছে কানাডা ছেড়ে চলে যেতে। এখন কী করব বলো?’
আমি আর কী করব? জানি এর কোনো সমাধান জানা নেই বা আমার হাতেও নেই। তাই বালাজিকে কোনো পরামর্শ দিতে পারিনি।

আরও পড়ুন

মানুষ কি সেই প্রাণী, যার বাঁচার ক্ষমতা অসীম? বা কথাটা কি এভাবে বলা যায়, মানুষের অসাধ্য কিচ্ছু নেই? মাত্র দেড় মাসের মাথায় বালাজি ফোনে জানায় সে বিয়ে করেছে এবং বউ তাঁর কারণেই ধর্ম বদলে মুসলিম হয়েছে।

ধর্ম নিয়ে বালাজির প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি আছে। শুরুতে যত না দেখেছি, বিয়ের পরও বালাজি মারিয়ামকে নিয়ে এ নিয়ে দুবার ঘুরে গেল। যেন দিন দিন বাড়ছে ব্যাপারটা। খুব অবাক লাগছে, কোন বিশ্বাস থেকে মানুষ এমন বাড়াবাড়ি করতে পারে? তা–ও আবার কানাডার মতো একটা দেশে।

মারিয়মকে নিয়ে যদিও এখনই কোনো কথা বলতে চাই না। কারণ, মেয়েটি অনেক ইয়াং। সে ছয় বছর বয়সে ইসরায়েল থেকে কানাডা এসেছে। মা–বাবার কথা না শুনে বালাজিকে বিয়ে করেছে। আবার বালাজির যেহেতু টাকাপয়সার টানাটানি আছে, মারিয়াম শেষমেশ কী করে, সেটা সময় বলবে। আজকে সকালে জানলাম, বালাজি আর মারিয়াম পরিচিত হয়েছে ডেটিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।

নাশতার টেবিলে বসে মারিয়াম গরগর করে ৭-৮টা সুরা মুখস্থ বলল। পুরোপুরি হিজাব ধরেছে, সেই সঙ্গে বালাজি ধরেছে আলখাল্লা। প্রতিমুহূর্তে অবাক হয়ে ওদেরকে নিরীক্ষণ করছিলাম আর বোঝার চেষ্টা করছিলাম; যদিও আবার বলছি, মাত্র ২২-২৩ বছরের ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো নিশ্চিত কথা বলা যায় না বা বলা উচিতও না। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মানসিক গঠন তৈরি হয় ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। সেদিক থেকে বালাজি ও মারিয়াম সেই সময়ের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে।

এ মুহূর্তে ভীষণ হাসি পাচ্ছে বাবু। তুই তো আছিস আমেরিকার ডালাস শহরে। আজকে বাসায় থাকলে নিশ্চয়ই অনেক অনেক প্রশ্ন করতি। বালাজি ও মারিয়াম মিলে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বোঝাল, আমার নাকি হিজাব পরা উচিত এবং সেটা ভীষণভাবে জরুরি কাজ। এই প্রথম ধর্ম নিয়ে কোনো আলোচনায় আমি একদম চুপ থাকলাম। কারণ, ধর্ম এত বেশি ব্যক্তিগত যে তা নিয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করতে রাজি না। এমনকি বাবা-মা, স্বামী, ভাইবোন কারও সঙ্গেই না।

বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষের বিশ্বাসের হিসাব একদম আলাদা। সে কী গ্রহণ করবে, কী করবে না—সেটা একান্তই তার ব্যাপার।

বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষের বিশ্বাসের হিসাব একদম আলাদা। সে কী গ্রহণ করবে, কী করবে না—সেটা একান্তই তার ব্যাপার। বাইরে থেকে ধর্ম কোনো অর্থ বহন করে না। মানে হলো—কে নামাজ পড়ল? কে চার্চে গেল? কে পূজা করল? সেটা তাদের নিজেদের ব্যাপার; আমাকে কে অধিকার দিয়েছে কথা বলার? যাক সেসব কথা। হিজাবের কথা মনে করতেই আরও পুরোনো এক কথা মনে পড়ল।

ঢাকাতে চাকরিজীবনেই হবে। কোনো এক কাজে ঢাকার বাইরে গেছি; এক সহকর্মী মহিলা হিজাব পরে আমার সঙ্গে কাজে যাচ্ছেন। এমনিতেই সেই সময় অনেক গরম আর মহিলার আঁটসাঁট কাপড় দেখে আমারই গরম লাগতে শুরু করে। বললাম, ‘আচ্ছা আপা, এই যে মাথা কালো কাপড় দিয়ে টাইট করে ঢেকে আছেন, আপনার সাফোকেশন লাগে না?’ মহিলা এত রেগে গেল যে সারা পথ আর কথা বলতেই পারলাম না।

রাতে যথারীতি আমরা এক রুমে আছি। আমি যখন ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়লাম; মহিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি নামাজ পড়েন নাকি?’
আমি বললাম, ‘কেন নামাজ পড়তে আপনার অনুমতি লাগে সেটা তো জানতাম না!’
মহিলা আবার বলে, ‘আপনার তো নামাজ হয় না।’
আমি আবার বললাম, ‘কেন আল্লাহর সঙ্গে কি আমার বিষয়ে আপনার আলাপ হয়েছে?’

সেদিনের কথা আর না বাবু। কিন্তু এখন আবার ১২ বছর পরে মেলাতে পারছি, বালাজি আর মারিয়ামও যেহেতু দেখল আমাকে নামাজ পড়তে; তাই আমাকে বোঝাল যে হিজাব পরা দরকার। হায়রে মানুষ। যদি কেউ কোনো দিন কারও ভেতরটা দেখতে পেত? বাইরে থেকে সিজদাহ দেওয়া মানুষই কি একমাত্র সেরা মানব?

দোয়া করি বালাজি আর মারিয়াম সুখী হোক। বালাজি কানাডায় স্থায়ী আবাস গড়ুক। বাবু, মিসিং ইউ এভরি মোমেন্ট সোনা বাচ্চা। দূর থেকে অনেক অনেক চুমু কলিজা বাচ্চা।

আদর বাসুন
মা
৫ জুলাই, ২০১২

ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা