বাসুন বারোতে (পর্ব তেরো)

চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।

অলংকরণ: তুলি
ফোন রেখে আমি অন্ধকার রাতে অবাক হয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কার সঙ্গে কথা বললাম আমি? আমার প্রিয় শিক্ষক আনিস স্যার, নাকি অন্য কেউ?

বাসুন,

আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গান আছে, ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি, আমার মনের ভেতরে…’

জীবনটাকে সময় সময় এই গানের মতোই মনে হয়। গত রাত থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে আনিস স্যারের কথা মনে পড়ছে। মানুষের জীবন কি এমন হয়, নাকি হওয়া উচিত?

বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমান। রবীন্দ্র গবেষক, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন গবেষক এবং একই সঙ্গে তিনি একজন গভীর আবেগপ্রবণ শিল্পীও। স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি গতকাল রাতে। কথোপকথনটা হুবহু বলি তোকে। ঢাকায় তখন সকাল ১০টা। স্যার ফোন ধরতেই আমি বললাম,
‘স্যার, আমি টরন্টো থেকে লুনা।’
‘ওহ লুনা,’ বলেই স্যার চুপ হয়ে গেলেন।
‘কেমন আছেন, স্যার?’
‘আমি কেমন আছি, সেটা জিজ্ঞেস করবে না। এটা বর্ণনা করার ব্যাপার নয়, বুঝলে লুনা। (স্যারের কণ্ঠে কোনো রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ-কষ্ট কিছুই নেই। যেন নিরুত্তাপ কণ্ঠ) কারণ, আমি একটা কথা বলব, তুমি আবার প্রশ্ন করবে; আবার আমি বলব, তুমি প্রশ্ন করবে; এভাবে কথা চালানোর অবস্থায় আমি আর নেই লুনা।’
‘তাহলে জানতে চাইব না, আপনি কেমন আছেন?’
‘না, তুমি জানতে চাইবে না কিছুই। আমি কোনো কথা বলব না। কিন্তু, তুমি লুনা আমার জন্য দোয়া করো। আমি যেন তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারি।’
‘ভালো থাকুন স্যার, আমি ছাড়ি।’
‘তুমিও ভালো থেকো।’

ফোন রেখে আমি অন্ধকার রাতে অবাক হয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কার সঙ্গে কথা বললাম আমি? আমার প্রিয় শিক্ষক আনিস স্যার, নাকি অন্য কেউ?

১৯৯৮ সালে মনে হয়, যে বছর অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পেলেন, ঠিক দুই দিন পরই ঢাকার জাদুঘর মিলনায়তনে বিশাল এক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের কোনো পেশার কোনো বিখ্যাত মানুষ সেদিন বাদ পড়েননি ওই অনুষ্ঠানে। অনেক কষ্টে সেদিন ঢুকেছিলাম সেখানে, নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন কথা বলছিলেন বাংলায়।

মঞ্চে বসে মনে হচ্ছিল, আমাদের দেশ নোবেল পেয়েছে। সেই হাজার আলোকবাতির ভেতর অমর্ত্য সেনকে কী যেন প্রশ্ন করলেন আনিস স্যার। জবাবে অমর্ত্য সেন বললেন, ‘আনিস, তুমি আমাকে প্রশ্ন করছ? তুমি তো জানোই যে নোবেল পাওয়া মানেই সব নয়। তুমি আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি জানো।’ সেদিন আরও একবার প্রিয় আনিস স্যারকে দেখেছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো।

আনিস স্যারের লেখা বই ‘যে আগুন জ্বলেছিল’ পড়েছিলাম ১৯৯৭ সালে। এমন বই কি কোনো দিন আমি পড়েছি এর আগে? বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার পরপরই অর্থনীতিবিদ আনিস স্যারসহ আরও কিছু মানুষ দেশ গড়ার চেতনায় যেসব কাজ করেছিলেন, সেগুলো কি জানবে বাংলাদেশের পরের প্রজন্ম?

দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য সারা দেশে গণ–আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। আনিস স্যার ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। দেশ গড়ার সেই সব দিনে স্যাররা যে উদাহরণ তৈরি করেছিলেন, তা আজও বিরল। সেগুলো কি তাহলে ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

স্যারের লেখা বই ‘উন্নয়ন জিজ্ঞাসা’ পড়ে সেদিন সন্ধায় স্যারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম, তারপর কত পথ। আরও আলোচনা চলতে থাকে বই নিয়ে! স্বাধীনতার পরপরই সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে কেন দেশকে এগিয়ে নেওয়া গেল না! আজকের বাংলাদেশ তো হওয়ার কথা ছিল না, স্বাধীনতার পর দেশের মানুষের ভেতর দেশকে গড়ে তোলার নতুন উদ্যম, উৎসাহ ছিল, সেই সময় দেশের সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছিল দুহাত বাড়িয়ে, কেন তা কাজে লাগানো যায়নি—এমন সব আলোচনা হয়েছে কত দিন।

আরও পড়ুন

বৃহত্তর রংপুর জেলার সৈয়দপুর থানার কুজিপুকুর গ্রামের সাধারণ নিরক্ষর মানুষেরা দেড় মাসের চেষ্টায় সারা থানার মানুষকে অক্ষর শিখিয়ে ফেলেছিলেন। ওই এলাকার মানুষেরা সে সময় বিদেশি সাহায্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এসবই লেখা আছে আনিস স্যারের ‘উন্নয়ন জিজ্ঞাসা’ ও ‘যে আগুন জ্বলেছিল’ বইয়ে।

অবাক হয়েছিলাম জেনে যে বাংলাদেশে এমন সব অসম্ভব ঘটনা ঘটেছিল, যা তরুণ প্রজন্মের কেউ জানেন না বা জানানোর ইতিহাস আমাদের দেশ তৈরি করতে দেয়নি। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিজে কুজিপুকুর গ্রামে গিয়েছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। জেনেছি ১৯৭৪-৭৫ সালে এই এলাকায় কত সব গণবিপ্লব হয়েছিল। আজ এই টরন্টো শহরে বসে নিজের এই সামান্য লেখা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, যে দেশের ট্রেনিংবিহীন আমজনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মাত্র ৯ মাসে বিপ্লব আনতে পারে; সেই দেশের মানুষ ৪০ বছরে দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে পারল না?

এমন কথা আর যে বিশ্বাস করে করুক বাসুন, আমি করি না, করব না। কারণ, আমি দেখেছি, এই সাধারণ মানুষেরাই আজও দেশের জন্য সব করতে পারে। সমস্যা হলো, দেশের ধান্ধাবাজ আর দুর্নীতিবাজ একটা উচ্চবিত্ত শ্রেণি যারা বড় বড় কথা বলে ৪০ বছর ধরে নিজেদের আখের গোছাল। স্যার তাঁর ‘উন্নয়ন জিজ্ঞাসা’ বইয়ে এসব কথা স্পষ্ট করে বলেছেন।

জানি, দেশের নতুন প্রজন্ম এসব বই চেনে না, জানে না। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের ইতিহাস গত ৩০ বছরের তরুণ প্রজন্ম জানে কি না, সেটা বলাই এখন বড় প্রশ্ন।

যে জাতি তার শিকড় চেনে না, সেই জাতি মাথা তুলে দাঁড়াবে, এমন চিন্তা কী করে করি বাবু? আমার সেই আনিস স্যার বললেন, ‘তুমি দোয়া করো, আমি যেন চলে যেতে পারি।’ কী অবাক লাগছে! কেন স্যার এভাবে কথা বললেন? দেশে কী হচ্ছে যে স্যারকে এত হতাশ শোনাল?

আমার জানালা দিয়ে বিকেলের আলো পড়ে এসেছে, বাবু। মোহনীয় বিকেলের আলো চারদিকে। আগামীকাল আরও একটা দিন শুরু হবে।

আমি আমার প্রজন্মের সেই ভাগ্যবান মানুষ, যে দেশের কিছু অসাধারণ সৎ মানুষকে চিনি। আমি জানি ও বিশ্বাস করি যে ভালো ও সৎ মানুষই বদলে দিতে পারে পৃথিবী। যত দূরেই থাকি না কেন বাবু, দেশের সেই সব মানুষের জন্য ভালোবাসা বয়ে বেড়াব বাকি জীবন।

আনিস স্যার, আপনাকে বিনম্র সালাম। আপনি সুস্থ থাকুন।

আদর, বাসুন
তোর মা
১০ এপ্রিল, ২০১২

ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা