ছায়ার বন্ধু

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

নতুন শহরের সকালগুলো আরিফের কাছে ধূসর মনে হয়। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর ক্ষণিকের জন্য মনে করতে পারে না, সে ঠিক কোথায় আছে! জানালার পর্দা সরালেই দেখা যায় সারি সারি অচেনা বাড়ি, অচেনা মুখ।

বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা। কয়েক বছর পরপরই বদলি হতে হয়। তাই আরিফের জীবনটা যেন পায়ে পায়ে ভেসে বেড়ানো কাগজের নৌকার মতো। কোথাও স্থির হওয়ার উপায় নেই। এ নিয়ে ছয় বছরে ওর চতুর্থ শহর, পঞ্চম স্কুল। স্কুল পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা যেন একেকটা যুদ্ধের মতো। নতুন বই, নতুন ক্লাসরুম, নতুন শিক্ষক তো আছেই; সবচেয়ে কঠিন কাজ নতুন বন্ধু পাওয়া।

বন্ধুত্ব হতে হয় স্বাভাবিক আর সহজ। কিন্তু আরিফের জন্য তা হয়ে গেছে দুর্লভ কোনো সম্পদের মতো। নতুন স্কুলে পা রাখার প্রথম দিন থেকেই টের পেয়েছিল, এখানেও ওর জায়গা নেই। সবাই ব্যস্ত নিজেদের দল নিয়ে, নিজেদের গল্প নিয়ে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বললে সেটা নিছক সৌজন্যমাত্র। হৃদ্যতা যেন হারিয়ে গেছে এদের প্রতিটি হাসিতে।

আরিফ অবাক হয়। কেউ ওকে ডাকছে, হাত নাড়ছে, এমনটা তো কখনো হয়নি। ইতস্ততভাবে উঠে দাঁড়ায়। জানালা দিয়ে আবার তাকায়। না, ভুল দেখেনি।

টিফিনে ওর চোখ যায় মাঠের দিকে। কেউ খেলছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ বেঞ্চে বসে গল্প করছে। আর আরিফ? সে কেবল জানালার পাশে বসে মাঠের মানুষগুলো দেখে, ঠিক যেন একজন বাইরের দর্শক, যাকে খেলার মাঠে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

একঘেয়ে দিনগুলোর মধ্যেই একদিন পরিবর্তন এল। স্কুলে দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হয়েছে। পুরো ক্লাস খালি। সবাই ক্যানটিনে। কেউ কেউ মাঠে গেছে, কেউ আবার বাথরুমে বা গোপনে শিক্ষকের চোখ এড়িয়ে গেম খেলছে। আরিফ যথারীতি জানালার ধারে বসে আছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে মাঠের কোনায় দাঁড়ানো একটি ছেলের দিকে। ছেলেটির গায়ে সাদা ইউনিফর্ম, চোখে ফ্রেমবিহীন চশমা, আর মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্ত হাসি।

আরিফ অবাক হয়। কেউ ওকে ডাকছে, হাত নাড়ছে, এমনটা তো কখনো হয়নি। ইতস্ততভাবে উঠে দাঁড়ায়। জানালা দিয়ে আবার তাকায়। না, ভুল দেখেনি। ছেলেটা সত্যিই তাকে ডাকছে। পরে যখন দেখা হয় মাঠের কোণে, ছেলেটি বলে, ‘তোমার নাম আরিফ, না?’ সে চমকে ওঠে। ছেলেটা তার নাম জানে কীভাবে? এই স্কুলে তো কিছুদিন আগেই এসেছে ও।

ছেলেটি হেসে জানায়, সে অনেক কিছু জানে। এমনকি বলে দেয়, আরিফ কোন বেঞ্চে বসে, কোন বইটি সবচেয়ে বেশি পড়ে, আর ক্লাসের কোন সময় সে সবচেয়ে নীরব হয়ে যায়। ছেলেটির নাম রিয়ান। রহস্যময় হলেও চোখে একধরনের আন্তরিকতা রয়েছে। বিষয়টা আরিফকে আকৃষ্ট করে। রিয়ানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। তার হাসি সাদামাটা, স্নিগ্ধ। কথাবার্তায় পরিণত চিন্তার ছাপ।

প্রতিদিন টিফিনে তারা দেখা করে। স্কুল শেষ হলে লাইব্রেরির পেছনের ঝোপের পাশে বসে গল্প করে। রিয়ান গল্প করে পুরোনো দিনের ক্লাস ফাইভের ক্রিকেট টিমের, স্কুলের বার্ষিক প্রদর্শনী, একবার পুকুরে পড়ে যাওয়ার ঘটনা। আরিফ অবাক হয়, রিয়ান সব জানে কীভাবে?

রিয়ান তাকে হাসতে শিখিয়েছে। সাহস জুগিয়েছে ক্লাসে হাত তুলে উত্তর দিতে। একদিন রিয়ানের উৎসাহে আরিফ স্কুলের গল্প প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এমন কিছু সে আগে কখনো ভাবেনি। একদিন সাহস করে আরিফ জানতে চায়, ‘তুই কোন সেকশনে পড়িস?’ রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু হেসে বলে, ‘আমি এখন আর পড়ি না।’

আরও পড়ুন

আরিফ ভাবে, সে মজা করছে। কিন্তু এরপর যা শুনল, তাতে ওর হৃদয় ধক করে উঠল। রিয়ান জানায়, সে এ স্কুলেই পড়ত। অনেক বছর আগে। একবার স্কুল টিমের হয়ে খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। মাথায় গুরুতর চোট লাগে। সে আর ফিরতে পারেনি। কিন্তু তার মন, আকাঙ্ক্ষা, বন্ধুত্বের অপেক্ষা রয়ে গেছে। আরিফের উদ্দেশে সে বলে, ‘তুমি সেই ছেলেটা, যে আমার মতো একা, নিঃসঙ্গ, চুপচাপ। আমি চেয়েছিলাম কমপক্ষে একবার কারও পাশে থাকতে, বন্ধুর মতো।’

পরদিন আরিফ আর খুঁজে পায় না রিয়ানকে। মাঠে, লাইব্রেরির পেছনে, জানালার ধারে যেখানেই সে থাকত সবখানেই খালি। একটা অদ্ভুত শূন্যতা ভর করে। সে বুঝতে পারে, বন্ধুটি বিদায় নিয়েছে। যেভাবে ছায়া সন্ধ্যায় মিশে যায় অন্ধকারে, সেভাবে। আরিফ বুঝতে পারে, রিয়ান তাকে বদলে দিয়েছে। এখন সে অন্যদের দিকে তাকায়, পাশে বসতে বলে। নতুন আসা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কী?’ সে জানে, একজন ছায়ার বন্ধুত্ব কেমন অলৌকিক হতে পারে।

সহসভাপতি, রাজশাহী বন্ধুসভা